অস্বাভাবিক গরমের দায় কি সরকার এড়াতে পারে?

গত মাসে অফিসের কাজে ঢাকা থেকে খুলনা হয়ে পাবনা-সিরাজগঞ্জ ঘুরে ঢাকা ফেরত আসি। পথে প্রায় দেশের এক-চতুর্থাংশ জায়গা ভ্রমণ করা হয়। অস্বাভাবিক গরম। ঢাকার বাইরে অন্তত ভেবেছিলাম, গাছের ছায়া দেখতে পাওয়া যাবে, কিন্তু কী দেখলাম?

আমাদের এই অস্বাভাবিক গরমের থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় কী? গাছ লাগানো এবং পানি সংরক্ষণ। খুলনা থেকে কুষ্টিয়া আসার পথে সবার নিশ্চয়ই যশোর রোডের শতবর্ষী বিশাল গাছগুলোর সঙ্গে পরিচয় আছে? দেখলাম সেই গাছগুলো কাটা হচ্ছে। সবার সামনেই। সড়ক সংস্কারের নামে সব জায়গায় কাটা হচ্ছে গাছ। রাস্তা থেকে সরে যাচ্ছে ছায়া। ঢাকার ঘটনা তো আমরা সবাই জানি। দেখার কে আছে? আগে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি খুব জোরে শোরে হতো, এখন কোথায়? এটা কার দায়িত্ব?

এরপর আসি পানির কথাতে। যত পুকুর দেখলাম, সবগুলোর পানির স্তর তলানিতে বা শুকিয়ে যাওয়া। কেন? গরম কি একমাত্র কারণ? অবশ্যই না। আমরা আমাদের মাটির কাছের পানি (সারফেস ওয়াটার) সেচ কাজে লাগিয়ে ফেলছি। এই জিনিস নিয়ে অনেক আগে থেকেই সতর্ক করা হয়েছিল। কিন্তু গ্রামেগঞ্জে কি কোনো প্রচার আছে? তাদের কি বিকল্প দেখানো হয়েছে? এই দায়িত্ব কাদের?

গ্রামের কথা বলে লাভ কী? শিক্ষিত মানুষের শহর ঢাকার পানির স্তরও অস্বাভাবিক নেমে গেছে। যার ফলাফল, ভূমিকম্পের মতো কোনো বড় দুর্যোগ হলে ঢাকার এত এত বড় দালানের কী হবে, কেউ আসলে জানেও না। আর একটা কথা, ঢাকার বিভিন্ন এলাকাতে যে ছোট ছোট পানির পাম্প আছে, কিছুদিন পরপর যে পানির অভাবে বন্ধ হয়ে যায়, বালু ওঠে, কেউ কি খেয়াল করে দেখেছেন? এই পানি দিয়ে কত দিন চলতে পারব?

আগে গরমে পানি শুকিয়ে গেলে সেই পানি আসত নদী থেকে। খালের পানি আমাদের কৃষিব্যবস্থাতেই নিয়ে এসেছিল অসাধারণ পরিবর্তন। এখন তো নদীতেই পানি নেই, খালে পানি আসবে কীভাবে? অন্য দেশের সঙ্গে অভিন্ন নদীর পানি নিশ্চিত করার দায়িত্ব কার? আমি আমার গত লেখাতে বলেছিলাম, আমাদের সরকারি কর্মকর্তারা বিদেশি পক্ষের সঙ্গে দর-কষাকষিতে (নেগোসিয়েশন) চরম দুর্বল। চুক্তি মোতাবেক সবাই আমাদের কাছ থেকে প্রাপ্য বুঝে নেয়, আমাদের দেশ কেন বুঝে নিতে পারে না?

একটা দেশের জন্য যে পরিমাণ বনভূমি এবং জলাশয় থাকার দরকার, তা কি আমাদের আছে? এগুলো কার রক্ষা করার দায়িত্ব? সরকার জলবায়ু তহবিল থেকে সাহায্য নিতে যতটা উদ্‌গ্রীব, ততটাই অনাগ্রহ পরিবেশ বাঁচানোর জন্য কিছু করতে? বাইরের দাতা সংস্থাগুলো আমাদের এই খাতে ঋণ দিতে চায়, কিন্তু আমাদের কাজের সক্ষমতা কতটুকু?

দেশে এত এত উন্নয়ন প্রজেক্ট হয়েছে—কতটির পরিবেশ সমীক্ষা হয়েছে? হ্যাঁ, কাগজে-কলমে সমীক্ষা হয়েছে এবং সেগুলা সঠিক কি না, কে পরীক্ষা করেছে? আর পরিবেশের ক্ষতির জন্য যা যা বাস্তবায়নের কথা প্রস্তাবনাতে থাকে, তা কি হচ্ছে? সারা পৃথিবীতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর চেষ্টাতে আছে, আমরা তথাকথিত উন্নয়নের নামে কয়লা আর ডিজেলে নিজেদের সক্ষমতা বাড়িয়েছি।

এখন অনেকেই বলবেন, অন্যান্য জায়গাতে কেন গাছ কাটা হচ্ছে বা জলাশয় ভরাট করা হচ্ছে? বেশ কিছু বছর ধরে আমাদের কাগজে-কলমে জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রায় স্থবির। তাহলে বসতভিটার জন্য এত জায়গা লাগছে কেন? প্রতিবছর আমাদের কৃষিজমি কমছে, আর তার প্রধান কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি।

পরিবেশ বিপর্যয়ের আর একটা বড় কারণ, কীটনাশক আর রাসায়নিক সার। আমাদের সব উপজেলাতেই কৃষি কর্মকর্তা আছেন, তাঁরা কতজন মানুষকে সচেতন করতে মাঠপর্যায়ে যান? কৃষকেরা তো তাঁদের স্বল্প জ্ঞান দিয়ে কাজ করবেনই, কিন্তু তাঁদের শিক্ষা দেওয়ার জন্যও তো আমাদের ব্যবস্থাপনা ও জনবল আছে। সেটা কেন পুরোদস্তুর কাজ করছে না?

বায়ুদূষণ নিয়ে সব থেকে ভালো উদাহরণ আমাদের নিজেদের দেশেই আছে। রাজশাহী তার দূষণের মাত্রা অনেক কমিয়েছে। দুই মেয়রের ঢাকা তাহলে কেন পিছিয়ে? ঢাকার সমস্যার ব্যাপারে আমরা সবাই জানি—কোনো কি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে? মানুষের কাছে জবাবদিহি না থাকার ফল এখন হাড়ে হাড়ে পাওয়া যাচ্ছে।

দেশে এত এত উন্নয়ন প্রজেক্ট হয়েছে—কতটির পরিবেশ সমীক্ষা হয়েছে? হ্যাঁ, কাগজে-কলমে সমীক্ষা হয়েছে এবং সেগুলা সঠিক কি না, কে পরীক্ষা করেছে? আর পরিবেশের ক্ষতির জন্য যা যা বাস্তবায়নের কথা প্রস্তাবনাতে থাকে, তা কি হচ্ছে? সারা পৃথিবীতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর চেষ্টাতে আছে, আমরা তথাকথিত উন্নয়নের নামে কয়লা আর ডিজেলে নিজেদের সক্ষমতা বাড়িয়েছি।

যখনই কোনো প্রজেক্টের প্রস্তাবনা আসে, বেসরকারি কোনো কোম্পানিকে বানাতে দেওয়া হয় অথবা কোনো বিদেশি কনসালট্যান্টকে। যে দেশের সব থেকে বেশি খরচ যায় পরিচালনা বাবদ, সেখানে এই অতিরিক্ত পরিচালনা খরচ থেকে আমাদের কতটুকু লাভ হচ্ছে? ওই কোম্পানিগুলো এমনভাবে প্রজেক্ট প্ল্যান করে, যাতে নিজেদের কোম্পানি বা সহযোগী কোম্পানিই কাজ পায়। তাহলে একজন মনিটরের মানুষ থাকলেই তো হয়, এত মানুষের তো দরকার নেই, তা-ই না?

বিটিভিতে আবুল খায়ের সাহেবের একটা অসাধারণ বিজ্ঞাপনমূলক নাটিকা ছিল গাছ লাগানো নিয়ে। আগে টিভিতে প্রায় এ রকম জনসচেতনতামূলক নাটিকা প্রচারিত হতো। এখন এত এত চ্যানেল। উন্নয়নের প্রচারণা আমরা সারা দিন দেখি, কিন্তু সাধারণ মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা, সেটা এখন দেখা যায় না। তথ্য মন্ত্রণালয়ের কি এ ব্যাপারে মনে আছে?

পরিবেশ খাতে বাজেটে বরাদ্দ থাকে মাত্র ১ শতাংশ। চলমান ভয়াবহ তাপদাহের কারণে পরিবেশ–প্রকৃতি রক্ষার দাবিতে এত কথা বলা হচ্ছে, তা এবারের বাজেটে প্রতিফলন হয়নি। এবার বরাদ্দ সামান্য বাড়লেও, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য। মানে সরকারের ও এই দিকে গুরুত্ব দেওয়ার খুব বেশি ইচ্ছা নেই। কিন্তু এই সামান্য টাকাও কি খুব ভালোভাবে বরাদ্দ হচ্ছে? প্রায় সব মন্ত্রণালয়ের কাজের সঙ্গে পরিবেশের ভূমিকা আছেই। তাই সেখান থেকেও বরাদ্দ নেওয়া যায়। দেশে পরিবেশ প্রকৌশল এবং বিজ্ঞান থেকে পাস করা হাজার হাজার শিক্ষিত তরুণ আছে। তাদের কি আমরা ব্যবহার করতে পারি না? আমি সব সময়ই বলি, এই দেশের ক্ষমতা আছে, কিন্তু নেই সক্ষমতা বাড়ানোর ইচ্ছা। যার যেখানে দরকার, সেখানে অদরকারি লোক বসে পুরো সিস্টেমটাকেই নষ্ট করে ফেলছে।

জাতিসংঘের মতে, সারা পৃথিবীই এখন উষ্ণতম সময় পার করছে। এর মধ্যেই দেশ এখন পরিবেশের দিক থেকে খুব বাজে অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। নিজেদের সক্ষমতা ব্যবহার করে এই অবস্থা মোকাবিলা এখন শুরু করতে না পারলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। নিজেদের সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য হলেও আপনারা নড়েচড়ে উঠুন।

বিস্তারিত পড়ুন প্রথম আলোতে

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top