বাংলাদেশের অর্থনীতি কি ঠিক পথে চলছে? সরকার অনেক চেষ্টা করে ডলারের দাম একটা স্থিতিশীল জায়গায় রাখার চেষ্টা করছে। তাতে কি ফলাফল আসছে?
প্রথমেই বলে নিই, বাংলাদেশ ব্যাংকের মে ২০২২–এর রিপোর্টে রিয়েল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট (অন্যান্য দেশের মুদ্রার তুলনায় কোন দেশের মুদ্রার মান কতটা শক্তিশালী) ছিল ১১৬ দশমিক ২ টাকা। (নতুন রেট পাওয়া যাবে জানুয়ারিতে)। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে এই রেট অবশ্যই বেড়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান রেট এখনো মে মাসের রেটের থেকেও কম। তাই ডলারের রেট সামনে না বাড়ার এখনো কোনো কারণ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। গত এক বছরে টাকার মান কমেছে ২৩ শতাংশের মতো, যেটা এশিয়ার মধ্যে সব থেকে বেশি। (বণিক বার্তা, ১ অক্টোবর, ২০২২)
সরকার এই অবস্থা ঠেকানোর জন্য তিন স্তরের ডলার রেট করে দিয়েছে। রেমিট্যান্সে অধিক সুবিধা আর প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে, যার তাৎক্ষণিক সুফল দেখা যাচ্ছে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স আসাতে। কিন্তু খোলা বাজারে ডলার রেট আরও বেড়ে যাওয়াতে মানুষ আবার হুন্ডির দিকে নজর দিয়েছে। এদিকে বিশ্বকাপ উপলক্ষে কাতার থেকে ফ্রি ভিসার মানুষজনকে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে রেমিট্যান্স খাত থেকে সরকার আশানুরূপ ফল আপাতত পাবে না।
আর একটা ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে। আমদানি আর রপ্তানির ডলার রেটের মধ্যে অবিশ্বাস্য পার্থক্য। আমদানিকে অনুৎসাহী করার চেষ্টা আর একটা খাতকে বিপদে ফেলেছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও আমাদের দেশের বেশির ভাগ (৯৫ শতাংশের বেশি) রপ্তানি খাত আমদানি করা কাঁচামালের ওপর নির্ভরশীল। এখন বেশি দামে কিনে কীভাবে এই অস্বাভাবিক মার্কেটে টিকে থাকা সম্ভব? ডলারের রেট বেড়ে যাওয়াতে রেকর্ড রপ্তানি আমরা দেখাতে পারছি। কিন্তু সেই সঙ্গে রেকর্ড আমদানিও আমরা দেখতে পাব। ফলাফল বাণিজ্য ঘাটতি আরও বাড়বে। আমদানি নিরুৎসাহী করার জন্য কাস্টমস অফিসের এবং ব্যাংকের কড়াকড়ি শিগগিরই রপ্তানি এবং সেবা খাতে পরিষ্কার নেতিবাচক চিত্র দেখা যাবে।
সংকট মোকাবিলা করতে প্রথম যেটা করণীয়, ঠিক তথ্য দিতে হবে। ইউরোপের অর্থমন্ত্রীদের মতো আমাদের অর্থমন্ত্রীরও উচিত সামনে এসে ব্রিফ করা। মূল্যস্ফীতির তথ্য আর জনসংখ্যার যে তথ্য পরিসংখ্যান ব্যুরো থেকে দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে। পাচার করা টাকা যেকোনো উপায়ে ফেরত আনতে হবে। খরচ কমানোতে সরকারকেই সামনে থেকে পথ দেখাতে হবে।
আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। সেপ্টেম্বরের হিসাবে যা ৩৬ বিলিয়ন ডলার হলেও আইএমএফের হিসাবে তা সাড়ে ২৮ বিলিয়ন ডলার। তার মানে আমাদের সরকারের যা লক্ষ্যমাত্রা ছিল, তা পূরণ হচ্ছে না। সরকার আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবি থেকে ৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ চেয়েছে। সংস্থাগুলো তা দিতে রাজিও হয়েছে, কিন্তু এই স্বল্প পরিমাণ ঋণ আসলে দেশের দুই মাসেরও খরচ জোগান দেওয়ার জন্য যথেষ্ট না। আর আইএমএফের শর্ত পালন করার মতো আমাদের মনমানসিকতা আছে কি না, সেটাও চিন্তার বিষয়। সরকারের আর একটা চেষ্টা ছিল পাচার করা টাকা ফেরত আনা, যা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। এরই মধ্যে শেষ ছয় বছরে দেশে কোটিপতি বেড়েছে প্রায় সাড়ে ছয় হাজারের মতো।
প্রথম আলো ১ আগস্ট ইআরডির বরাত দিয়ে বলেছিল বাংলাদেশের ২০২০-২১ অর্থবছরে সুদাসল শোধ করেছে ২ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৪-২৫–এ ৪ বিলিয়ন ডলার হবে। কিন্তু আইএমএফের মতে, সরকারি সব রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের ঋণও সরকারের। আর সে হিসেবে ইআরডির ওয়েবসাইটে গত ১৭ ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত ‘ফ্লো অব এক্সটার্নাল রিসোর্সেস ইনটু বাংলাদেশ ২০২০-২১’ রিপোর্ট অনুসারে বাংলাদেশ ২০২০-২১ অর্থবছরে সুদাসল শোধ করেছে প্রায় ৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। তার মানে ঋণ শোধের চাপে ইতিমধ্যে পরে গেছে।
এরই মধ্যে অন্য প্যারামিটারগুলোও খুব সহায়তা করছে বলে আশা করা যাচ্ছে না। সম্প্রতি উইওন নিউজ ইউএসের শীর্ষ সিইওদের মধ্যে একটা সমীক্ষা চালিয়েছে, যেখানে ৯১ শতাংশ সিইও মনে করছেন যদি ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এই ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হয় তবুও ২০২৩–এ বৈশ্বিক মন্দা আসবে। ৬৬ শতাংশ সিইও মনে করছেন মন্দা প্রলম্বিত হবে। বাংলাদেশে প্রাইভেট কোম্পানির সিইওদের মূল্য দেওয়া না হলেও প্রথম শ্রেণির দেশে ওদের মতামত নীতি তৈরিতে বেশ ভূমিকা রাখে।
এই যুদ্ধ শেষ হওয়ার কোনো চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। ফলাফল ইউক্রেন থেকে খাদ্য সরবরাহ অনিশ্চিত। ওপেক জ্বালানি তেলের সরবরাহ বাড়াবে না বলেছে। তাতে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। দেশেও বিদ্যুৎ–সংকট, তেলের মূল্যবৃদ্ধি, উষ্ণায়নের জন্য এবার খাদ্যশস্যের ফলন কম হতে পারে। ফলাফল দাম বেড়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। কমে যাচ্ছে অন্যান্য উৎপাদনও। সরকার খরচ কমানোর জন্য যা যা করণীয় ঠিক করেছিল, তা নিজেরাই পালন করতে পারছে না, সব চাপ এসে পড়ছে সাধারণ মানুষের ওপর। আর তাদের কষ্ট দেখার কেউ নেই।
সংকট মোকাবিলা করতে প্রথম যেটা করণীয়, ঠিক তথ্য দিতে হবে। ইউরোপের অর্থমন্ত্রীদের মতো আমাদের অর্থমন্ত্রীরও উচিত সামনে এসে ব্রিফ করা। মূল্যস্ফীতির তথ্য আর জনসংখ্যার যে তথ্য পরিসংখ্যান ব্যুরো থেকে দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে। পাচার করা টাকা যেকোনো উপায়ে ফেরত আনতে হবে। খরচ কমানোতে সরকারকেই সামনে থেকে পথ দেখাতে হবে। সরকারি খাতে খরচ কমানোর অনেক জায়গা এখনো বিদ্যমান। আর সব থেকে বড় প্রয়োজন, দলমতনির্বিশেষে এক হয়ে, বিভিন্ন শিল্প বিশেষজ্ঞ আর একাডেমিশিয়ান দিয়ে কমিটি গঠন করে নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা করা।
আমরা চাই না বড় কোনো সংকট আমাদের দেশে আসুক। কিন্তু দেবালয় পুড়লে নগর কীভাবে রক্ষা পাবে? সারা পৃথিবীতে আগুন জ্বলছে, আগের বৈশ্বিক মন্দা থেকে আমরা বেঁচে গেলেও এবার বেঁচে যাওয়ার লক্ষণ খুব বেশি দেখা যাচ্ছে না।
বিস্তারিত পড়ুন প্রথম আলোতে