বর্তমান বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, ডলারের মান কী হবে? আমাদের দেশ আমদানি–রপ্তানিতে পুরোপুরি ডলারনির্ভর। এদিকের ডলারের রিজার্ভও কমছে। মূল্যস্ফীতি গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। পাচার হওয়া টাকা ফেরত আসার কোনো লক্ষণ নেই। ফলাফল, সরকার পড়েছে এক দুষ্টচক্রের মধ্যে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর গত ৬ নভেম্বর ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সভায় বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি একেবারে তলানিতে ঠেকেছে। তাঁর মতে, আর তো নিচে নামার পথ নেই, যার ক্ষতিকর অবস্থা আসলে আমজনতার ওপরে গিয়েই পড়ছে।
বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সিদ্ধান্ত মোতাবেক, প্রবাসী ও রপ্তানি আয় কেনায় ডলারের দাম পড়বে ১০৯ টাকা ৭৫ পয়সা আর আমদানিতে পড়বে ১১০ টাকা ২৫ পয়সা। তারা এই সংকটের মধ্যে ডলারের দাম কমানোর সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, চলতি হিসাবে এখন ডলারের কোনো সংকট নেই। যেহেতু আমাদের দেশ আমদানিনির্ভর, এর ফলে সরকার আশা করছে জিনিসের দাম বাড়বে না। এদিকে ব্যাংকের টাকাও কিছু কম খরচ হলো।
জিনিসের দাম কমানো কেন মুখ্য হলো? সরকারি হিসাবে আমাদের মুদ্রাস্ফীতি গত অক্টোবরে ছিল ৯ দশমিক ৬৩। এখন এ তথ্য নিয়ে প্রশ্ন করা যায়? কারণ, বাংলাদেশের মুদ্রাস্ফীতি বেশ কিছু দিন ধরে একটা সরলরেখা ধরে চলছে, যা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
বণিক বার্তা বাংলাদেশের আশপাশের দেশের সঙ্গে তুলনা করে দেখিয়েছিল আশপাশের সব দেশের মুদ্রাস্ফীতি কমবেশি হচ্ছে, কিন্তু আমাদের চলছে সরলরেখায় অনেক দিন, যা বাস্তবের নিরিখে অসম্ভব। এটি ছোটবেলায় আমাদের প্র্যাকটিক্যাল খাতায় উত্তর মিলিয়ে দেওয়ার কথা মনে পড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংক কি কোনো ভূমিকা রাখছে না?
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) গবেষণায় দেশের মূল্যস্ফীতির গত বছর মার্চে দেখিয়েছিল, বিবিএস যে মূল্যস্ফীতি দেখায়, বাস্তবে মূল্যস্ফীতি তার দ্বিগুণ। সেই হিসাবে মূল্যস্ফীতি এখন ১৮–এর কাছাকাছি, যা দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সেরা। সরকার এ অবস্থায় নির্বাচনের আগে আর ও মূল্যস্ফীতির দায় নিতে চাইছে না। আইএমএফের শর্ত পালনে টাকা ছাপানো বন্ধ করেছে সরকার, অন্যদিকে অনেক ব্যাংক ভুগছে তারল্যসংকটে। এই জন্য বাড়তি টাকার ভার তারাও নিতে চাইছে না।
আমাদের রিজার্ভ কমছে। এটা ঠেকানোর জন্য চারটি কাজ প্রয়োজন—রেমিট্যান্স বৈধ পথে নিয়ে আসা, যেসব এলসির পেমেন্ট হয়নি, সেগুলো নিয়ে আসা, রপ্তানি বাড়ানো এবং পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনা। কিন্তু এগুলো বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না।
একটা সময় ডলারের বিনিময়মূল্য নিয়ম ভেঙে ১২৮ পর্যন্ত উঠে গিয়েছিল। কিন্তু ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা বা বাইরের কোনো চাপের জন্য এলসির সব টাকা দেশে আসছে না, এদিকে বিভিন্ন দেশ থেকে রপ্তানি আয়ও কমছে। এ ক্ষেত্রে সরকার যা করেছে—আমদানি কমিয়ে দিয়েছে। বড় বড় কোম্পানি বা অলিগার্কদের জন্য এই বাধা কার্যকর না হলেও মধ্যম সারির কোম্পানিগুলোর ত্রাহি দশা। মূলধনী যন্ত্রপাতিও এখন আমদানিতে আটকে গেছে। ফলে ব্যবসা হয়ে গেছে স্থবির।
এরপর আসে আইএমএফের চাপ। আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী আগামী বছর জুনের মধ্যে নেট রিজার্ভ থাকতে হবে ২০ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার। যেখানে প্রতি মাসেই রিজার্ভ কমছে, সেখানে সাত মাসে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা বেশ দুরূহ। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক দুই ধরনের চেষ্টা করছে, তারা অন্য ব্যাংকে ডলার বিক্রি বন্ধ করে তাদের থেকে ডলার কিনছে এবং বাইরের থেকে ঋণ নেওয়ার চেষ্টা করছে। ফলাফল, আমদানি আরও কমবে। রিজার্ভ কমে যাওয়ায় আমাদের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতাও দিন দিন কমছে।
আইএমএফের একটা শর্ত আছে ডলারের দাম বাজারের ওপর ভিত্তি করে ছেড়ে দেবে। আমরা কি তা ছাড়ছি? বাজার দর কত, এটা নিয়ে ধারণা পাওয়া না গেলেও রিয়েল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট দেখে ধারণা পাওয়া যায় কত হওয়া উচিত। গত জুনে প্রকাশিত আমাদের আর্থিক নীতিতে অবাস্তব হলেও দেখানো ডলারের দাম দেখানো হয়েছিল ১১০–এর কাছাকাছি।
বেলজিয়ামভিত্তিক গবেষণা সংস্থায় ব্রুগেল তাদের গত ১৯ নভেম্বর প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখিয়েছে, বাংলাদেশে ডলারের সাপেক্ষে টাকার রিয়েল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট ছিল ১৫৫ দশমিক ৯১। ফলে ডলারের দাম বাড়বে বলেই মনে হয়। আর তা অন্তত এই মূল্যমানের নিচে বা কাছাকাছি থাকবে। এর ফলে রেমিট্যান্স আসা অবশ্যই বাড়বে। ডলারের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতি আবারও বাড়বে। এর জন্য সরকারের যা করতে হবে, তা হচ্ছে ব্যাংকের সুদ বাড়ানো। কিন্তু তার জন্য বিবিএসের মাধ্যমে আসল মূল্যস্ফীতি বের করতে হবে। শ্রীলঙ্কা যে তার ঝামেলা থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছে, তার বড় কারণ হচ্ছে তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা। আমাদের দেশে তা অনুপস্থিত। আবার অর্থমন্ত্রীকেও সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে দেখা যায় না।
আমাদের রিজার্ভঘাটতি পূরণে সরকারের সদিচ্ছায় যে ঘাটতি রয়েছে, তার বড় উদাহরণ এখনো হুন্ডি বন্ধ না করার চেষ্টা। ফলে এর মাধ্যমে অনেক মুদ্রা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এদিকে সবাই বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার কথা বলছে। গবেষণায় দেখা যায়, নিষেধাজ্ঞা ২ দশমিক ৩ থেকে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি কমিয়ে দেয়, রপ্তানি কমিয়ে দিতে পারে ২২ থেকে ৭৮ শতাংশ পর্যন্ত। রাশিয়ার জিডিপি কমেছিল ১১ দশমিক ২ শতাংশ। বাংলাদেশের অর্থনীতি এই ধকল নেওয়ার জন্য একেবারেই প্রস্তুত নয়।
এ ছাড়া অজানা আরও অনেক কিছুর মুখোমুখি আমাদের হতে হবে, যাতে সব হিসাব–নিকাশ ও তথ্য-উপাত্ত বদলে যাবে। আর তাই সরকারের উচিত দেশের মানুষের স্বার্থে হলেও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ঠিক করে কোনো ভবিষ্যৎ বিপদ থেকে দেশকে রক্ষা করা। দেশ ও দেশের মানুষকে রক্ষার দায়িত্ব তো সরকারেই।
‘ফিলিপ কার্ভ’ অনুসারে মুদ্রাস্ফীতি বেশি হলে কর্মসংস্থান বাড়ে। কিন্তু যদি মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সঙ্গে কর্মসংস্থান না বাড়ে, সে অবস্থাকে বলা হয় স্ট্যাগফ্লেশন বা নিশ্চলতাস্ফীতি। মোট দেশজ উৎপাদনে দেশের ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির তুলনায় সামগ্রিক কর্মসংস্থান বেড়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ৩৩ শতাংশ, যা আমাদের আরও নিশ্চলতাস্ফীতির দিকে এগিয়ে যাওয়াকেই নির্দেশ করে।