দেশের প্রকৃত জনসংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি, মাথাপিছু আয় ও আয়বৈষম্য

মাথাপিছু আয় নিয়ে অনেকে অনেক ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। আয়বৈষম্য নিয়েও প্রচুর কথা হচ্ছে। কিন্তু এর প্রাথমিক মান নির্ধারক যে জনসংখ্যা, তা নিয়ে কেউ কথা বলেন না।

শুরুতেই একটা কৌতুক দিয়ে শুরু করি—‘সংখ্যা হচ্ছে মানুষের মতো। অত্যাচার করো, তুমি যা শুনতে চাও তা-ই বলবে।’ কোনো প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক প্রতিবেদন বিষয়ে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মজার কিছু তথ্য পেলাম, হিসাবরক্ষক একই ডেটা দিয়ে প্রতিষ্ঠানকে লাভজনক দেখাতে পারেন, আবার লোকসানি দেখাতে পারেন। এটা তো গেল ছোট পরিসরে। বড় পরিসরে এই দায়িত্বে থাকে পরিসংখ্যান ব্যুরো।

কিছুদিন ধরে দেশের মানুষের আলোচনার বিষয়, আমাদের জিডিপি আর মাথাপিছু আয়। অর্থনীতিবিদদের মতে, জিডিপি যদিও উন্নয়নের সূচক হয় না, কিন্তু আমাদের সরকার জিডিপিকে মাইলস্টোন হিসেবে দেখায়। এখন দেখে আসি, সাধারণভাবে জিডিপি কী? একটি দেশের অভ্যন্তরে এক বছরে চূড়ান্তভাবে উৎপাদিত দ্রব্য ও সেবার বাজারে সামষ্টিক মূল্যই হচ্ছে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি বা গ্রোস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট)। আগের বছরের তুলনায় পরের বছরে এ উৎপাদন যে হারে বাড়ে, সেটি হচ্ছে জিডিপির প্রবৃদ্ধি। বাংলাদেশে জিডিপি হিসাব করতে গিয়ে ১৫টি খাত ও উপখাতের বাজারমূল্য হিসাব করা হয়; এগুলোরই ডেটা পাওয়া যায়।

এরপর আসি মাথাপিছু আয় নিয়ে। মাথাপিছু আয় বলতে কোনো দেশের মোট আয়কে জনপ্রতি ভাগ করে দিলে যা হয়, তাকে বোঝায়। জনগণের সর্বমোট ব্যক্তিগত আয়কে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে মাথাপিছু আয় পাওয়া যায়। এখানেই আসছে জনমিতির কথা।

আমরা কি জানি, বাংলাদেশের জনসংখ্যা কত? ১৯৯৭ সালে যখন ছাত্রাবস্থায় পড়ে এসেছি, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৫ কোটি। ২০১৪ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যা ১৬ দশমিক ৪৬ কোটি। এটা আদমশুমারির এই তথ্য কি প্রশ্নবিদ্ধ নয়? নাকি আগের বইয়ে ভুল ছিল? জন্মনিবন্ধন অনুসারে আমাদের জনসংখ্যা ১৭ কোটি ১০ লাখ (প্রথম আলো, ১৭ অক্টোবর, ২০১৯)। আবার বিবিসির গত মাসের এক প্রতিবেদন জানাচ্ছে, বাংলাদেশে কয়েক কোটি মানুষের জন্মনিবন্ধন তথ্য সার্ভারেই নেই। উল্লেখিত তথ্যগুলোর ভিত্তিতে ধারণা করা যায়, দেশের অন্তত ২০ শতাংশের মতো মানুষ এখনো জন্মনিবন্ধনই করেনি।

আমাদের এই জিডিপি বা মাথাপিছু আয় নিয়ে অনেকে অনেক ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। আয়বৈষম্য নিয়েও প্রচুর কথা হচ্ছে। কিন্তু এর প্রাথমিক মান নির্ধারক যে জনসংখ্যা, তা নিয়ে কেউ কথা বলেন না। যদি ২০ কোটি লোকের আয়কে ১৬ কোটি লোকের আয় হিসাবে দেখানো হয়, তখন মাথাপিছু আয় বেশি হবেই, সেরকম ২০ কোটির ভোগের চাহিদা হিসাব করে ১৬ কোটিতে রূপান্তরিত করলে জিডিপিও বেশি হবে।

এখন দেখি ন্যাশনাল আইডির ডেটা কী বলে? বাংলাদেশে রেজিস্টার্ড ভোটার প্রায় ১০ কোটি ৯৮ লাখ ১৯ হাজার ১১২ জন। এ বছর নতুন যুক্ত হয়েছে ৫৫ লাখ ১৯ হাজার ৩০ জন নতুন ভোটার। (টিবিএস নিউজ, ১২ মার্চ ২০২০) ১ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত প্রতি স্ল্যাবে ৫৫ লাখ করে ধরলেও সেই হিসেবে দেশের জনসংখ্যা ২০ কোটির কাছে। তাও এদের অনেকে ভোটার হয় না। সিটি পপুলেশনের ডেটা মতে, আমাদের জুলাই, ২০১৯ এর প্রাক্কলিত জনসংখ্যা ১৮ কোটি ৮৬ লাখ।

আমাদের এই জিডিপি বা মাথাপিছু আয় নিয়ে অনেকে অনেক ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। আয়বৈষম্য নিয়েও প্রচুর কথা হচ্ছে। কিন্তু এর প্রাথমিক মান নির্ধারক যে জনসংখ্যা, তা নিয়ে কেউ কথা বলেন না। যদি ২০ কোটি লোকের আয়কে ১৬ কোটি লোকের আয় হিসাবে দেখানো হয়, তখন মাথাপিছু আয় বেশি হবেই, সেরকম ২০ কোটির ভোগের চাহিদা হিসাব করে ১৬ কোটিতে রূপান্তরিত করলে জিডিপিও বেশি হবে। আমি আর অন্য প্যারামিটারে না যাই। শুধু একটা প্রশ্ন কি আসে না? আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও কেন আমাদের বিশাল পরিমাণ চাল বা গম বাইরে থেকে আনতে হয়? কারণ, ১৬ কোটির হিসাবে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ, ২০ কোটির জন্য না।

ইনফ্লেডেট ডেটা নিয়ে ভুল করার সবচেয়ে বড় উদাহরণ ভেনেজুয়েলা। তেলের ওপর নির্ভর করে একসময় জিডিপি আর মাথাপিছু আয়ে পৃথিবীর সব থেকে ধনী দেশের কাতারে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু আয়বৈষম্য আর ফোলানো ডেটার মিথ্যা মোহে নিজেদের খারাপ সময়ের জন্য রেডি ছিল না। ফলাফল, তারা এখন গরিব দেশের কাতারে। (বাংলাদেশও কিন্তু এক গার্মেন্টসের ওপর নির্ভরশীল)।

এদিকে উন্নত বিশ্বে, যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের দিকে তাকালে ওদের হিসাব একেবারেই যথার্থ। জনসংখ্যা যা-ই হোক, একটি সম্ভাব্য হিসাব মাথায় রেখেই তারা কাজ করে। যাতে কোনো অর্থনৈতিক ধাক্কা এলেও কিছুটা সামাল দেওয়া যায়।

আমরা ছোটবেলা থেকেই পড়ে আসছি, আমাদের প্রথম সমস্যা জনসংখ্যা, যা এখন আর শোনা যায় না। উন্নয়নের বাতাসে সবাইকে জনশক্তিতে রূপান্তরের স্বপ্ন দেখছি, কিন্তু কীভাবে শক্তি করা হবে তার পরিকল্পনা নেই। পুরা দেশটা মানুষে গিজগিজ করেছে, সবাই ছুটছে, বেশির ভাগই অনিশ্চিতের পথে।

আমাদের সরকার পোশাক খাত থেকে বের হয়ে একাধিক খাতে দেশের ব্যবসা বাড়ানোর চেষ্টা করছে, যা ভিশন ২০৪১ দেখলেই বোঝা যায়। কিন্তু একটা দেশ তখনই উন্নয়ন করতে পারে, যখন তাদের কাছে ঠিকমতো ডেটা বা তথ্য থাকবে, আর তা মানুষের উপকারে লাগবে। যা সঠিক তথ্যের প্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে পরিকল্পনাও নিশ্চিত করা হবে। প্রবাদ আছে, মিথ্যা তিন রকম-মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা আর পরিসংখ্যান।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো কি এই ধারার বাইরে এসে সরকারকে সঠিক ডেটা দিয়ে দেশ গঠনে সাহায্য করতে পারবে? পরিসংখ্যান ব্যুরোর ভুলের দায় কিন্তু সরকারের ওপরে এসেই পরে, যার খেসারত দিতে হয় সাধারণ মানুষকে।

বিস্তারিত পড়ুন প্রথম আলোতে

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top