বাংলাদেশেও চার দিনের অফিস চালু করা সম্ভব, যদি…

সম্প্রতি অনেকের নিউজফিডে চার দিনের কর্মদিবস নিয়ে ডেইলি স্টার–এর একটা লেখা ঘুরছে আর সেখানে সবাই এসে যাঁর যাঁর মতো হতাশাপূর্ণ মন্তব্য করে যাচ্ছেন। আসল ঘটনা হচ্ছে, যুক্তরাজ্য চার কর্মদিবসের সবচেয়ে বড় ট্রায়াল করছে। যুক্তরাষ্ট্রের আগেও ইউরোপের অনেক দেশে ট্রায়াল করে সফলতা পেয়েছে। আর তার ঢেউ এসে পড়েছে এশিয়ায়ও। আরব আমিরাতে পাঁচ দিনের জায়গায় সাড়ে চার দিনের কর্মদিবসে যাচ্ছে, এমনকি কাজপাগল জাপানের কিছু কোম্পানিও ট্রায়াল শুরু করেছে।

প্রথমেই বলে দিই আমি মূলত প্রাইভেট সেক্টরের কর্মকর্তাদের নিয়েই লিখব। শুরুতেই বলে দিই কাদের জন্য চার কর্মদিবস একেবারেই অসম্ভব:

১. যাঁরা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যুক্ত আছেন
২. যাঁরা নানা প্রকল্পে কাজ করেন
৩. যাঁরা জরুরি সেবায় যুক্ত আছেন
৪. যাঁরা দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করেন

এর কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশ সব সময় নিম্ন বেতনের জন্য বাজারে একটা দামের সুবিধা পায়, যেটা তাহলে একেবারেই হারিয়ে যাবে এবং অনেক কাজ ধীর হয়ে যাবে। যারা সরকারি সেবা খাত আর সরাসরি ব্যবসা খাতের সঙ্গে সংযুক্ত, তাদের বাদ রেখে এই ব্যবস্থা চালু করা পুরোপুরি সম্ভব। করোনার সময় দেখেছি, ৫০ শতাংশ মানুষ দিয়েও সরকারি খাতের কাজ মোটামুটি সুষ্ঠুভাবে চলেছে। আর একটু কাজের মধ্যে আধুনিকতা আর রোস্টার আনলে তিন দিন ছুটি অবাস্তব হবে না।

এখন দেখি, তিন দিনের ছুটিতে কী সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে? এ ব্যাপারে হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের একটা গবেষণা আছে। ভারী কথাতে না গিয়ে বরং সোজা কথায় বলি। তারা গবেষণা করে দেখিয়েছে, মানুষের মন সবচেয়ে বেশি কাজ করে ফ্রি টাইমে। এ ছাড়া মানুষজনকে তাঁর কাজের স্বাধীনতা দিলে ও কাজের সফলতার হার বেড়ে যায়। এ ছাড়া আরও সুবিধার মধ্যে আছে মানুষ ছুটি শেষে বিশ্রাম নিয়ে আসতে পারবেন, কোম্পানির প্রতি দায়বদ্ধতা বাড়বে, অফিসের অপারেশনাল খরচ কমবে, পরিবেশের ক্ষতি কমবে। নিউজিল্যান্ড তাদের ট্রায়াল শেষে যে রিপোর্ট দিয়েছে, সেখানে ওপরের সুবিধাগুলো স্বীকার করা হয়েছে।

বাংলাদেশের মানুষের কর্মঘণ্টা কত? সকাল–বিকেল দুই বেলা যানজট ঠেলে অফিস যাওয়া, তারপর ৯ ঘণ্টা অফিস (লাঞ্চসহ), প্রায় ১৩ ঘণ্টা এখানেই যায়। সঙ্গে মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেটের জন্য অনেকেরই বাসায় গিয়েও কাজ করতে হয়। আবার শুক্রবার প্রায় সব দেশ খোলা, আমাদের যাঁদের বাইরের সঙ্গে কাজ করতে হয়, তাঁদের মাফ নেই, শুক্রবারও কাজ করো। এদিকে শনিবার থেকে দেশের কাজ শুরু হয়ে যায়। কাজ করতে করতে নিঃশেষ হতে খুব বেশি বাকি নেই আমাদের।

তিন দিনের ছুটি, এটা ভবিষ্যতে আজ হোক কাল হোক আসবেই। কোম্পানির মালিকদেরও তাই এই নিও নরমাল পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত হতে হবে—মানসিকভাবে আর আস্তে আস্তে কাজের পরিবেশ সৃষ্টি করে। আমাদের সবার কাজের জন্য সুস্থ–সবল, সৃজনশীল মানুষ প্রয়োজন। বার্ন আউট করে যদি অথর্ব (মস্তিষ্কহীন পরিশ্রম অর্থে) বানিয়ে ফেলি, তাহলে কারও কোনো লাভ নেই। আর তাই নতুন কিছু এলে আগেই বাতিলে না ফেলে কীভাবে নতুনত্বকে গ্রহণ করা সম্ভব, সেটাই সবারই চিন্তা করা উচিত।

তাহলে দেখি আমাদের দেশে কী কী করা সম্ভব
১. প্রথমেই বলে নিই দেশের অনেক অফিস এক দিনের ছুটি দিয়ে চলছে। তাদের সবার আগে দুই দিনের ছুটি নিশ্চিত করতে হবে। করোনার পর অনেক অফিস বেতন কমিয়ে দুই দিনের ছুটিতে চলে গেছে আর তাদের কোনো কাজ এই জন্য বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, এখন পর্যন্ত শোনা যায়নি।

২. শুক্রবারের সরকারি ছুটি বদলে রোববারে নিয়ে যাওয়া দরকার হতে পারে। অবশ্যই নামাজ আর দুপুরের খাবারের জন্য অন্তত দুই–আড়াই ঘণ্টা ছুটি থাকতে হবে এদিন। এটা আমাদের জন্য নতুন কিছু নয়, যেসব কোম্পানি ২৪ ঘণ্টা কাজ করে এবং ইমার্জেন্সি সার্ভিসে বা সেবা খাতে যারা কাজ করে, তারা এই নিয়মেই চলছে।

৩. কর্মঘণ্টার নিয়ম শিথিল করা খুব দরকার। অনেক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি চালু করে দিয়েছে। আমাদের এত যানজট, তাতে অফিস টাইম মেনে চলা বেশ কঠিন। তাই যখনই আসো অফিসের কর্মঘণ্টা যেন কমে না যায়।

৪. ভার্চ্যুয়াল অফিস ব্যবস্থা চালু করা। করোনাকালে নিও নরমালে সারা পৃথিবীতেই জনপ্রিয় এখন হোম অফিস আর ভার্চ্যুয়াল অফিস। মিটিংয়ের জন্য যাতায়াত না করে বাসা থেকেই করে ফেললে অনেক কর্মঘণ্টা কমানো সম্ভব, সেই সময়ে অন্য কাজ বা বিশ্রাম নেওয়া সম্ভব। তবে একটি কথা—হোম অফিসে অনেক মালিককে দেখেছি রাত ৮-৯টায় মিটিং রাখে। কেন ভাই? অফিস টাইমে কি অফিসের কাজ করা যায় না? সবারই তো ফ্যামিলি টাইম আছে, নাকি? যাঁদের যেদিন অফিসে প্রয়োজন নেই, হোম অফিস দিলে এখন তো সমস্যা হওয়ার কথা না, কারণ সবাই এখন অভ্যস্ত।

৫. সবার কাজের দক্ষতা বাড়াতে হবে। ইউরোপ বা জাপানের মানুষ যখন কাজ করে, কাজ মানে কাজ। কিন্তু আমরা আড্ডা, ফেসবুক, চা ব্রেক এই সব করে অনেক সময় নষ্ট করি। বাংলাদেশের মানুষের কর্মদক্ষতা নিয়ে নিয়োগকর্তাদের কিন্তু অনেক অভিযোগ। তারপর দোষ হয় কোম্পানি বেশি সময় খাটায়। কিন্তু সব দোষ কোম্পানির না! তেমনি কোম্পানিও কারও কাজ শেষ হয়ে গেলে কর্মঘণ্টার অজুহাতে বসিয়ে রাখার কোনো দরকার দেখি না। মালিক বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা মনে করেন চাকরিজীবীদের অফিসে বেশি সময় বসিয়ে রাখলে ব্যবসায় সফলতা অবশ্যম্ভাবী। এতে আসলে দক্ষ কর্মীদের প্রতি কিছুটা হলেও অবিচার হয়। চাকরিজীবীদের যেমন দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে তেমনি মালিকদের কর্মপরিবেশ উন্নয়ন করতে হবে।

ভারতে একটা সমীক্ষায় প্রায় ৬০ শতাংশ চাকরিজীবীই তিন দিনের ছুটিতে লাভবান হবে বলেছেন। বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের দেশ এমনকি প্রথম বিশ্ব ছাড়া বেশির ভাগ দেশই এখনো চার কর্মদিবসের জন্য প্রস্তুত না। আমাদের দরকার বিশ্রামের মাধ্যমে সবাই যাতে নিঃশেষ না হয়, সবার যেন দক্ষতা বৃদ্ধি পায়, সেটা নিশ্চিত করা। ওপরের কাজগুলোর মাধ্যমে যা কিছুটা হলেও সম্ভব। তিন দিনের ছুটি, এটা ভবিষ্যতে আজ হোক কাল হোক আসবেই। কোম্পানির মালিকদেরও তাই এই নিও নরমাল পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত হতে হবে—মানসিকভাবে আর আস্তে আস্তে কাজের পরিবেশ সৃষ্টি করে।
সবশেষে আমাদের সবার কাজের জন্য সুস্থ–সবল, সৃজনশীল মানুষ প্রয়োজন। বার্ন আউট করে যদি অথর্ব (মস্তিষ্কহীন পরিশ্রম অর্থে) বানিয়ে ফেলি, তাহলে কারও কোনো লাভ নেই। আর তাই নতুন কিছু এলে আগেই বাতিলে না ফেলে কীভাবে নতুনত্বকে গ্রহণ করা সম্ভব, সেটাই সবারই চিন্তা করা উচিত।

বিস্তারিত পড়ুন প্রথম আলোতে

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top