ধূমপানে ‘দূর্বার গতিতে এগিয়ে’ চলছে বাংলাদেশ

ভালোর দিক দিয়ে বাংলাদেশ খুব বেশি এগোতে না পারলেও খারাপ সবকিছুতেই এগিয়ে যায়। যেমন ধূমপান। ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউয়ের ২০২৩ সালের ডেটা অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৫ বছরের ওপরে ধূমপায়ীর সংখ্যা শতকরা ৩৯ দশমিক ১, যা ২০১৯ সালেও ছিল ৩৫ শতাংশ। এখন ছেলেদের মধ্যে ধূমপায়ীর সংখ্যা ৬০ দশমিক ৬ শতাংশ এবং মেয়েদের মধ্যে এ সংখ্যা ১৭ দশমিক ৭ শতাংশ। মেয়েদের সংখ্যা ২০১৯ সালে ছিল ৭ শতাংশের মতো। ধূমপানে বিশ্বের মধ্যে আমাদের অবস্থান অষ্টম।

যে দেশে এত ধূমপায়ী, সেই দেশ বায়ুদূষণের মধ্যে তো প্রথম দিকেই থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। নিজেদের দিকে না তাকিয়ে চোখ বুজে সরকার, সমাজ সবাইকে দায়ী করি।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, সিগারেটের ধোঁয়া ডিজেলের ধোঁয়ার থেকে ১০ গুণ বেশি ক্ষতিকর। বদ্ধ জায়গাতে ধূমপান আপনার প্রিয় মানুষের যে ক্ষতি করে, তা অন্য বায়ুদূষিত শহরের থেকে বেশি। আপনি জেনেশুনে আপনার প্রিয় মানুষদেরই ক্ষতি করছেন, ভাবতে কি খুব ভালো লাগছে? ধূমপানের জন্য প্রতিবছর বাংলাদেশে ১ লাখ ২৬ হাজার মানুষ মারা যান। পরোক্ষ ধূমপানের কারণে আরও মারা যান ২৪ হাজার ৭৫৭ জন (ডেইলি স্টার, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯)। বলবেন, বাসাতে তো খাই না। কিন্তু বাইরে যে খাচ্ছেন, সেটাও বাতাসে মিশিয়ে দিচ্ছে প্রায় ৭ হাজার রাসায়নিক পদার্থ।

সেটা কারও না কারও শরীরে যাচ্ছেই। সেই বাতাস আপনার প্রিয়জন নিচ্ছে না, গ্যারান্টি দিতে পারবেন? ধূমপানের কারণে নীরব বিষে আক্রান্ত হচ্ছে কয়েক কোটি মানুষ। ধূমপান শুধু বায়ুদূষণ নয়, মাটিদূষণ এবং বনায়নেরও ক্ষতি করে।

ধূমপানের জন্য স্বাস্থ্যের ক্ষতির মাত্রা আমরা সবাই জানি। শ্বাসতন্ত্রের রোগ, ক্যানসার, হৃদ্‌রোগ, যৌন ক্ষমতা হ্রাস, ফিগার নষ্ট হওয়া থেকে শুরু করে সবকিছুতেই ভূমিকা রয়েছে ধূমপানের। দেশে অসংক্রামক রোগে মারা যান ৬৭ শতাংশ মানুষ। এর মধ্যে হৃদরোগে মৃত্যুর হার ৩০, ক্যানসারে ১২, শ্বাসতন্ত্রের রোগে ১০, ডায়াবেটিসে ৩ এবং অন্য অসংক্রামক রোগে ১২ শতাংশ মারা যান। এসব রোগীর প্রতি ২৮ জনে ২৫ জন ধূমপায়ী এবং মাত্র ৩ জন অধূমপায়ী (কালবেলা, ১৬ নভেম্বর ২০২২)।

ধূমপানের কারণে দেশে ৩০ বছরের ওপরে অসুস্থ মানুষ প্রায় ৭০ লাখ (ডেইলি স্টার, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯)। ধূমপায়ী ভাইবোনেরা, আপনাদের কাশির সমস্যার মূল কারণ কিন্তু এই ধূমপান, যা দিয়ে অনেক রোগের শুরু।

ধূমপান আবার সব মাদকেরই মা। যুক্তরাজ্যের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ধূমপায়ীদের মাদক গ্রহণের পরিমাণ অধূমপায়ীদের তুলনায় ২২ গুণ বেশি। (যুগান্তর, ৯ জানুয়ারি ২০২২)। আমাদের দেশে ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজাসহ যত মাদকগ্রহণকারী আছে, প্রায় সবার হাতেখড়ি এই সিগারেট দিয়ে। অন্য মাদক শুধু গ্রহণকারী ব্যক্তির ক্ষতি করে, কিন্তু ধূমপান আশপাশের মানুষ, পরিবেশ—সবকিছুর ক্ষতি করে।

বাংলাদেশ মুসলিমপ্রধান দেশ। ধর্মীয়ভাবে এখানে ধূমপানকে নিরুৎসাহিত করা হয়। অনেক মুসলিম দেশে ফতোয়া দিয়ে ধূমপানের ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। এরপরেও ধূমপান এমন এক আসক্তি, তা সহজে ছাড়তে পারে না মানুষ।

দেশে প্রকাশ্যে ধূমপানের বিপক্ষে আইন আছে। ৩০০ টাকা জরিমানা আছে। কখনো প্রয়োগ দেখা যায় না। দেখা যাবে কি করে, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার মধ্যেই তো অনেক ধূমপায়ী আছেন। সরকার তামাক ইন্ডাস্ট্রির বিপক্ষে ব্যবস্থাও নিতে পারবে না। বেশি ট্যাক্স দেওয়া খাতের একটি তারা। তাদের অবদান জিডিপির ১ দশমিক ৪ শতাংশ।

সরকার যা করে বছর বছর ট্যাক্স বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু নেশাজাত দ্রব্যে ট্যাক্স বাড়িয়ে ব্যবহার কমানো যায় না। তার প্রমাণ সংখ্যা বৃদ্ধিতেই দেখা যায়। আমাদের দেশের মানুষ একটা করে শলাকা কিনতে পারে। সেই জন্য তাদের কাছে একবারে অনেক টাকার প্রেসার হয় না। আর যেহেতু প্যাকেট কিনছে না, তাই প্যাকেটে লেখা সাবধানবাণী চোখেও পড়ে না। সরকার আর একটা কাজ করতে পারে, ২৩ বছরের নিচে ধূমপান নিষিদ্ধ করতে পারে। এই সময়টাতেই বন্ধুদের প্ররোচনাতে বা হিরোগিরি দেখাতে এবং মেয়েরাও চায় ছেলেরা পারলে আমরাও পারব, এসব কারণে মানুষ বেশি নেশার খপ্পরে পড়ে।

ধূমপান এমন একটা জিনিস, যার কোনো ভালো দিক নেই। নিজের ক্ষতি করছেন, পরিবেশকে ধ্বংস করছেন, অপচয় করছেন। আপনাদের জন্য আমাদের মতো অধূমপায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ধূমপানের কারণে দেশে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ক্ষতি হয় প্রতিবছর ৩০ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। দেশে শিশুদের ৫০-৬০ শতাংশ শ্বাসনালির বিভিন্ন রোগে ভুগছে, আর তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দায় আমাদের দূষিত বায়ু এবং পরোক্ষ ধূমপান। আসুন না, এই রোজাতেই ধূমপান ছাড়ার চেষ্টা শুরু করি। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য হলেও একটা ধূমপানমুক্ত দেশ আশা কি করতে পারি না আমরা?

বিস্তারিত পড়ুন প্রথম আলোতে

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top