বাংলাদেশের শ্রমিকদের জন্য আছে শ্রম আইন, সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য আছে নিজেদের বিধান, ব্যাংকের জন্য আছে বাংলাদেশ ব্যাংক আইন। কিন্তু বেসরকারি কর্মকর্তাদের জন্য কোনো আইন নেই।
বাংলাদেশে এখন সরকারি চাকরির রমরমা অবস্থা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে গেলে দেখা যাবে, সবাই বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত। ট্রল হচ্ছে, অন্তত ৫০টা দেশের জনসংখ্যার থেকে আমাদের বিসিএস পরীক্ষার্থী বেশি। কেনই-বা হবে না? দেশের বেসরকারি খাতের চাকরির অবস্থা যে খুবই করুণ। কিন্তু আজ থেকে ১০ বছর আগেও এ রকম ছিল না। এখন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়াররাও নিজেদের খাত ছেড়ে স্বপ্নের সোনার হরিণের পেছনে ছুটছেন।
বাংলাদেশের শ্রমিকদের জন্য আছে শ্রম আইন, সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য আছে নিজেদের বিধান, ব্যাংকের জন্য আছে বাংলাদেশ ব্যাংক আইন। কিন্তু বেসরকারি কর্মকর্তাদের জন্য কোনো আইন নেই। ফলাফল, দেশের বেসরকারি খাতের মূল সমস্যা—তারা এখন যোগ্য প্রার্থী পাচ্ছে না। আর যে বেসরকারি খাত দেশের মূল চালিকা শক্তি (সরকারি খাত মূলত প্রশাসনিক এবং প্ল্যানিং এ থাকে), তা-ই এখন স্থবির।
অনেকেই বলেন, কেন লেবার আইন বেসরকারি খাতের জন্য প্রযোজ্য নয়? আপাত অর্থে, যিনি শ্রম দেন তিনিই শ্রমিক, সেই হিসেবে মালিক ছাড়া কোনো কোম্পানির সবাই শ্রমিক। কিন্তু বাংলাদেশ শ্রম আইন ও বিধিমালায় শ্রমিকের সংজ্ঞা ভিন্ন। বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকের সংজ্ঞা—‘শ্রমিক অর্থ শিক্ষাধীনসহ কোনো ব্যক্তি, তাহার চাকরির শর্তাবলি প্রকাশ্য বা ঊহ্য, যেভাবেই থাকুক না কেন, যিনি কোনো প্রতিষ্ঠানে বা শিল্পে সরাসরি বা কোনো ঠিকাদার (যে নামেই অভিহিত হোক না কেন)-এর মাধ্যমে মজুরি বা অর্থের বিনিময়ে কোনো দক্ষ, অদক্ষ, কায়িক, কারিগরি, ব্যবসা উন্নয়নমূলক অথবা কেরানিগিরি কাজ করার জন্য নিযুক্ত হন, কিন্তু প্রশাসনিক, তদারকি কর্মকর্তা বা ব্যবস্থাপনামূলক কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি ইহার অন্তর্ভুক্ত হবেন না।’
তার মানে, প্রশাসনিক, তদারকি কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনামূলক কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি অন্তর্ভুক্ত হবে না। বিদেশে যাকে হোয়াইট কলার জবও বলে। আমি এসব কর্মকর্তার কথাই বলছি।
এই আইনের প্রশ্ন খুব বড় হয়ে দেখা দিল কোভিড আসার পর। অনেক কোম্পানি তার অধীনস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এক মাসের বেসিক দিয়ে ছাঁটাই করে দিয়েছে। তখন খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল, তথাকথিত কর্মকর্তাদের জন্য দ্য কন্ট্রাক্ট অ্যাক্ট-১৮৭২ প্রযোজ্য। যার মূল কথা, সবার যে যে অ্যাগ্রিমেন্ট আছে, তা অনুযায়ী কাজ করা। যা যেকোনো অ্যাগ্রিমেন্টের জন্যই প্রযোজ্য। আজ থেকে ১৫০ বছর আগের আইনে এখনো তারা বন্দী। ফলাফল অ্যাগ্রিমেন্টে যা আছে, তা-ই দিয়ে যা খুশি করা যাচ্ছে। অনেকে আরও স্মার্ট নতুন অ্যাগ্রিমেন্ট করে বেতনও কমিয়েছে।
সরকার এই কোভিডের সময় গার্মেন্টস আর ব্যাংকের লোকজনের চাকরি ঠেকানোর ব্যবস্থা নিলেও বেসরকারি বাকি খাতগুলো ছিল বাইরে। কিন্তু বাকি খাতেও কাজ করে প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ।
এরপর আসি বেতনের ক্ষেত্রে। দেশে শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি থাকলেও নেই তথাকথিত কর্মকর্তাদের। আর অনেকে এখনো নামে কর্মকর্তা হয়ে শ্রমিকদের কাছাকাছি বেতনে বেঁচে আছে। শ্রমিকদের তো তা-ও ওভারটাইম আছে, তাদের জন্য এটাও নেই। সরকারি চাকরিজীবী আর ব্যাংকাররা তো অন্তত তিনটা বোনাস পান, যা বেসিকের সঙ্গে সম্পর্কিত। বেসরকারি খাতের নতুন ট্রেন্ড দুইটা ঈদ বোনাস, যার পরিমাণ এখন আর এক বেসিক নয়। অ্যাগ্রিমেন্টের মাধ্যমে যা আছে, তাই দেওয়া হবে।
এরপর আসি বেতনের ক্ষেত্রে। দেশে শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি থাকলেও নেই তথাকথিত কর্মকর্তাদের। আর অনেকে এখনো নামে কর্মকর্তা হয়ে শ্রমিকদের কাছাকাছি বেতনে বেঁচে আছে। শ্রমিকদের তো তা-ও ওভারটাইম আছে, তাদের জন্য এটাও নেই। সরকারি চাকরিজীবী আর ব্যাংকাররা তো অন্তত তিনটা বোনাস পান, যা বেসিকের সঙ্গে সম্পর্কিত। বেসরকারি খাতের নতুন ট্রেন্ড দুইটা ঈদ বোনাস, যার পরিমাণ এখন আর এক বেসিক নয়। অ্যাগ্রিমেন্টের মাধ্যমে যা আছে, তাই দেওয়া হবে।
প্রায় সব দেশেই কমন পেনশন স্কিম, গ্র্যাচুইটি আর প্রভিডেন্ট ফান্ড আছে। সাবেক অর্থমন্ত্রী মুহিত এটা করতে চেয়েছিলেনও। কয়েক দিন আগে প্রধানমন্ত্রী ৬০ বছর বয়সের ওপরের মানুষের জন্য পেনশন ব্যবস্থা চালু করতে বলেছেন। মধ্যম আয়ের দেশ হলেও আমাদের এটা নেই। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে—আমাদের আইনে প্রভিডেন্ট ফান্ড বা গ্র্যাচুইটি বাধ্যতামূলক নয়। সরকার যেহেতু চালু করতে পারেনি এখনো, প্রাইভেট কোম্পানির জন্য আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকাতে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ৬০ বছর তো চাকরি করলেন—ভবিষ্যৎ কী? অবস্থা বুঝতে বেশি কিছু চিন্তা করা লাগে না—সংবাদপত্রে বিভিন্ন সাহায্যের আবেদন দেখলেই বোঝা যাবে দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির হাতে জমানো টাকা নেই। আজ থেকে ২০ বছর আগেও যে শ্রেণির মানুষ লজ্জায় সাহায্য চাইতেন না, তাঁরা এখন আর কুণ্ঠিত নয়। টিসিবির লাইনও একটা বড় প্রমাণ।
এদিকে আমাদের দেশে প্রফিট শেয়ারিংয়ের বাধ্যকতা থাকলেও (‘কারও পেইড আপ ক্যাপিটাল যদি এক কোটির ওপর হয়, তাহলে ডাব্লিউপিপিএফ এবং ডাব্লিউএফে ৫% প্রফিট শেয়ার দিতে হবে’) কয়টা কোম্পানি তা মানে? এখন যেকোনো ছোটখাটো কোম্পানিরও পেইড আপ ক্যাপিটালের থেকে বেশি।
আর একটা বিষয় বেশির ভাগ কোম্পানির ক্ষেত্রেই নেই—মেডিকেল বা স্বাস্থ্যবিমা। সবাই বেতনের অংশ হিসাবে একটা ভাতা দিয়ে দেন, ফলাফল কেউ কোনো সময় অসুস্থ হলে নিজের সঞ্চয় ভাঙা ছাড়া উপায় নেই।
দেখা যাচ্ছে, বেসরকারি কর্মকর্তাদের চাকরিজীবনে পুরোটাই মালিকদের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে চলতে হচ্ছে। কিন্তু অবসর গ্রহণের পর কী আছে? নিজের জমানো টাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। সরকারি চাকরি এবং ব্যাংকের সামাজিক নিরাপত্তার জন্য বরাদ্দ থাকলেও সমাজের বাকি ৭০ শতাংশ চাকরিজীবীর জন্য তা মালিকের ঐচ্ছিক। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলি, আমার কোম্পানি, যা তার ক্ষেত্রে পৃথিবীর সব থেকে বড় কোম্পানিও। যখন বাংলাদেশে অফিস খুলল, মানব সম্পদ বিভাগের সঙ্গে নীতি তৈরি করার সময় এক কথা—তুমি কেন এত কিছু চাইছ? তোমাদের কোনো আইনে কি আছে? আমাকে দেখাও। আমি দেব। নইলে খরচ কেন বাড়াব? এটা এখন নতুন আসা বেশির ভাগ কোম্পানিরই মুখের ভাষা।
এখন দেখি আমাদের পাশের দেশ ভারতের কী আছে? ওদের যেকোনো হোয়াইট কলার চাকরিজীবীর জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি আর হেলথ ইন্স্যুরেন্স বাধ্যতামূলক। সরকারিভাবেই এটা তদারকি এবং নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সরকার থেকে স্বাস্থ্যবিমা সুবিধা দিলে কিন্তু সরকারের অনেক ভর্তুকিও কমে যায়।
এক কোভিড দেখিয়েছে বেসরকারি কর্মকর্তারা কত অসহায়, কতজন মুখ লুকিয়ে সরকারি সাহায্য নিয়েছেন। কিন্তু আফসোস, এদের নিয়ে কথা বলার কেউ নেই। নিজেদের কথা বলার মতো নেই কোনো প্ল্যাটফর্ম। এটাও চুক্তি দিয়ে নিষিদ্ধ করা। আধুনিক কলুর বলদের এক জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছে বেসরকারি খাতের কর্মকর্তারা।
দেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশ, হু হু করে মাথাপিছু আয় বাড়ছে। কিন্তু সেই সঙ্গে কমছে মালিকদের খরচ কমানোর চেষ্টা, বিদেশি কোম্পানির মানবসম্পদ বিভাগে লোকজন (যাঁদের অনেকেই আবার ভারতীয়) খরচ কমানো তাঁদের পারফরমেন্সের অংশ বানিয়ে করছে নিষ্পেষণ। অন্যদিকে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর ভালোমন্দ নিয়ে চিন্তা করার অবকাশ যেন সরকারের নেই। আর কত দিন?
বিস্তারিত পড়ুন প্রথম আলোতে