বাংলাদেশ এখন সবচেয়ে বাজে অর্থনৈতিক সময় কাটাচ্ছে। এই সংকট কাটানোর জন্য ঋণ পেতে আইএমএফের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। কিন্তু ঋণ পাওয়ার প্রধান দুইটা শর্তই পূরণ করতে পারেনি সরকার। একটা নেট রিজার্ভ ২৪.৪৬ বিলিয়ন রাখা। কিন্তু নেট রিজার্ভ কত তা আর জনসম্মুখেই প্রকাশই হচ্ছে না। আর একটা রাজস্ব আয় ১৫ হাজার কোটি টাকা কম হওয়া। এর মধ্যে টাকা পাচার, ব্যাংক লোন ফিরিয়ে আনার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা সরকার এখনো নেয়নি। ফলে বের হয়ে আসার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে না। এর মধ্যে বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে, দেশকে আগামী ৪ মাসে ১২ বিলিয়ন ডলার লোন শোধ করতে হবে।
এই ধারা থেকে বের হয়ে আসার জন্য সবাই উন্মুখ হয়ে ছিল বাজেটের দিকে। এই বাজেটে লক্ষণীয় বিষয় ছিল সরকারের সব থেকে বড় খরচ যায় বেতন ভাতা (২২.২ শতাংশ) আর পেনশনে (৭.৪ শতাংশ)। এই অবস্থায় আসলে করণীয় ছিল খরচ কমানোর চেষ্টা করা। কিন্তু সেই চেষ্টা কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। সাময়িক সময়ের কিছু ঘটনা দেখলেই বোঝা যায়, সরকারি চাকরিজীবীদের বেশি সুবিধা দিয়ে জনগণের মধ্যে আয়–বৈষম্য কীভাবে বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
প্রণোদনা: প্রথম কাজ করা হয়েছে বেতনের নিয়মিত ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্টের সঙ্গে ৫ শতাংশ প্রণোদনা। সৎ সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য সময় উপযোগী সিদ্ধান্ত। হয়তো বা বাজেট (বা আইএমএফের) চাপে নতুন পে স্কেল দিতে পারেনি সরকার। এখন মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতি সমন্বয় করা সারা বিশ্বেই হয়। কিন্তু এটা করতে গিয়ে তিনটা জায়গাতে চাপ দিয়ে গেছে।
১. কেন প্রতিবছর অতিরিক্ত ৫ শতাংশ প্রণোদনা দিতে হবে? সরকার কি এখনই বুঝে গেছে, প্রতি বছর ১০ শতাংশ করেই মূল্যস্ফীতি থাকবে? বাজার অর্থনীতিতে এটা একটা অগ্রিম সিগনাল গেল না?
২. এই বেতন বৃদ্ধির ফলে বাজারে এক দফা দামের পরিবর্তন হয়। সেটা নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
৩. বেসরকারি ৯৫% জনগণের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাদের জন্য কোনো নির্দেশনা নেই।
দেশের সরকারি লোকজন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। কিন্তু তাদের অনেকেই এখন শাসক শ্রেণির অংশ হয়ে যাচ্ছে। স্পষ্টত রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও তাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক কাজ করতে দেখা যাচ্ছে। যেহেতু তারা সরকারি দলের হয়ে কাজ করছে, তাদের জন্য আইন কাজ করছে না, এবং তারা সরকার থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে যাচ্ছে। এর জন্য কোথাও কোনো জবাবদিহি দেখা যায় না। যা নির্বাচনের বছরে আরও দৃষ্টিকটু। যদিও সরকারি দল তা থোড়াই কেয়ার করছে।
দায়মুক্তি: সরকারি চাকরিজীবীদের গ্রেপ্তার করতে নিতে হবে পূর্বানুমতি। যা আগে কোর্টের রায়ে বাতিল হয়ে গেলেও ২০২৩ এর সংশোধনে আবার ফিরে এসেছে। দেশে দুর্নীতির একটা বড় আঙুল থাকে কিছু সরকারি চাকরিজীবীদের ওপর। মন্ত্রীও বলেছিলেন বেগম পাড়াতে সব থেকে বেশি বাড়ি সরকারি চাকরিজীবীদের। এ ছাড়াও ‘সরল মনে করা ভুল’ হিসেবে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন প্রজেক্টের আইনে। কেন এই দায়মুক্তি? তাহলে এই দায় মুক্তি কি তাদের আর ও অনুপ্রাণিত করবে না? সংবাদমাধ্যমে জানা যাচ্ছে, দুদক থেকে এ রকম দায়মুক্তি পেয়েছে ৮৪ জন সরকারি চাকরিজীবী, (ঢাকা পোস্ট ১৩ মার্চ, ২০২৩)। এভাবে আর কত?
অতিরিক্ত পদোন্নতি: প্রথম আলো পত্রিকায় ৫ আগস্ট এক লেখার বিষয় ছিল নির্বাচনের আগে আরও পদোন্নতি আসছে। যেখানে এখন যা আছে তার থেকে এক পজিশনে লোকবল বাড়িয়ে দেবে। এবং যেখানে দলীয় আনুগত্য বিবেচ্য হবে। যদি তাই হয়, এর ফলে আবারও খরচ বাড়বে, অনেক যোগ্য মানুষ হবে বঞ্চিত। এটি কি অবিচারের উদাহরণ নয়?
গাড়ির মূল্যসীমা বৃদ্ধি: যেখানে সরকার ডলার এবং খরচ কমানোর জন্য ২ জুলাই সব গাড়ি কেনা বন্ধ করেছিল, তা আগস্টেই রহিত করে বরং টাকার সীমা আরও বাড়িয়ে দিল। এই টাকা জনগণের টাকা শুধু মাত্র বিলাসিতাতেই খরচ করা হবে। শুধু এটিই নয়, নির্বাচনের জন্য ডিসি-ইউএনওদের জন্য গাড়ি কেনার বাজেট করা হয়েছে ৩৮০ কোটি টাকা। এভাবে কত অপচয় হবে দেশে?
ট্যাক্স সুযোগ: ১৯ জুলাই, ২০২৩ এনবিআর থেকে ইস্যু করা প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সরকারি কর্মচারীদের মূল বেতন আর বোনাস ছাড়া বাকি সব ভাতার ক্ষেত্রে আয়কর ছাড়ের সুবিধা দিয়েছে। (বাংলা ট্রিবিউন ১৯ জুলাই, ২০২৩) এটাও দেশের দ্বৈত নীতির একটা প্রতিফলন। যখন সরকার ট্যাক্স সংগ্রহের জন্য সবার ওপর বিভিন্ন ভাবে কর চাপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, সেখানে এক পক্ষ স্পষ্ট সুবিধাভোগী হয়ে যাচ্ছে। আর বস্তুত দেশের সব ট্যাক্সের বোঝা বহন করতে হচ্ছে বেসরকারি খাতকেই।
পেনশন সুবিধা: সরকার সর্বজনীন পেনশন সুবিধা নিয়ে এসেছে। যা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। এখানে সবাই নিজে টাকা দিয়ে ব্যাংকিং রেটে পেনশন সুবিধা পাবে। যদিও এটা নিয়ে সমালোচনা উঠেছে। সরকার এই স্কিমে সরকারি চাকরিজীবীদের যুক্ত করে তার বিশাল যে ৭.৪ শতাংশ খরচ তা কমাতে পারত। আর সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশন হবে সবার করের টাকাতে, অন্যদের জন্য কনট্রিবিউটেড হলেও শুধু ব্যাংক সুদ ছাড়াও সরকারি মুনাফা (এই টাকা দিয়ে সরকার ব্যবসা করে যে আয় করবে) তা যুক্ত এবং অবশ্যই ট্যাক্সের একটা অংশ যুক্ত করা উচিত। এটাও এখন পর্যন্ত দ্বৈত আইন হিসেবেই রয়ে গেছে।
এভাবে স্পষ্টতই সরকার দেশের মানুষের মধ্যে সুবিধা দিয়ে বিভাজনের নীতি নিয়েছে। এই বিভাজন দেশে দুই শ্রেণির চাকরিজীবী তৈরি করছে। এই বিভাজনই শিক্ষার্থীদের সরকারি চাকরির প্রতি ঝুঁকতে উৎসাহিত করছে বলা যায়। এ কারণে বিসিএস পরীক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত ঝোঁক আমরা দেখে থাকি, আজ থেকে ১৫ বছর আগেও যা ছিল না।
দেশের সরকারি লোকজন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। কিন্তু তাদের অনেকেই এখন শাসক শ্রেণির অংশ হয়ে যাচ্ছে। স্পষ্টত রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও তাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক কাজ করতে দেখা যাচ্ছে। যেহেতু তারা সরকারি দলের হয়ে কাজ করছে, তাদের জন্য আইন কাজ করছে না, এবং তারা সরকার থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে যাচ্ছে। এর জন্য কোথাও কোনো জবাবদিহি দেখা যায় না। যা নির্বাচনের বছরে আরও দৃষ্টিকটু। যদিও সরকারি দল তা থোড়াই কেয়ার করছে।
যেখানে জবাবদিহি প্রদর্শনের অভাব, গণতন্ত্র এবং সুশাসন নিয়ে শ্রীলঙ্কা তাদের অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠছে, যেমন তাদের মূল্যস্ফীতি নেমে এখন ৬.৪ শতাংশ। সেখানে আমরা ‘তেলা মাথাতে তেল দেওয়ার’ নীতি অবলম্বন করে এখনো সেই আগের অবস্থানেই ঘুরপাক খাচ্ছি।
বিস্তারিত পড়ুন প্রথম আলোতে