আমরা কলামলেখকেরা নাকি শুধু হতাশা ছড়াই। নতুন কিছু দেখতে পাই না; ভালো কিছু ছড়াতে চাই না। তাই ২০২৩ সালের শুরুতে ভাবলাম, এবার হতাশা ছড়াব না। বরং আসুন সবাই মিলে একটু আত্মোপলব্ধি করি। কীভাবে?
আমাদের সবার নিজের দেশ নিয়ে স্বপ্ন আছে। মজা হচ্ছে, আমরা যেসব দেশকে স্বপ্নের দেশ হিসেবে ভাবি, সেসব দেশের নাগরিকেরাও স্বপ্ন দেখে। ইন্টারনেটে তাদের অনেক লেখা পাওয়া যায়, পাওয়া যায় না বাংলাদেশ নিয়ে লেখা। আসুন, আজ আমাদের স্বপ্নের দেশ কেমন হতে পারে, দেখি।
প্রথমেই শুরু করি নিরাপত্তা নিয়ে। রাত ১১টার পর আমরা গাড়ি ছাড়া বাইরে থাকলেই পরিবার চিন্তায় পড়ে। অথচ আমরা এমন একটা দেশ চাই, যেখানে গভীর রাতে নিশ্চিন্তে বাসায় আসতে পারি। এটা শুধু ছেলেদের জন্য নয়, মেয়েদের জন্যও। খুব কঠিন? আমাদের পুলিশকে এ লক্ষ্য দিয়ে গঠন করা হলে কি তা অসম্ভব হবে? তাদের সক্ষমতা তো অন্য জায়গায় নষ্ট হচ্ছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে আমাদের একটা চাওয়া—স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা চাই।
এরপর আসি স্বাস্থ্য খাতে। আমাদের সরকারি চিকিৎসা খাত তাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করে। এর মানে তাদের সাধ্য কম। আমরা এমন একটা স্বাস্থ্যব্যবস্থা চাই, যেখানে সবাই যাতে চিকিৎসা পায়। এ জন্য সাধ্য বাড়ানোর পরিকল্পনা এখন থেকে করলে কেন হবে না? ৬৪ জেলায় ৬৪টি স্বয়ংসম্পূর্ণ হাসপাতাল চাওয়া কি খুব বেশি দাবি? আর সবার জন্য চিকিৎসা ইনস্যুরেন্স কিন্তু আমাদের পাশের দেশেই হচ্ছে। কত পরিবারকে কঠিন অসুখে পথে বসতে দেখেছি। আমরাও তো এখন মধ্যম আয়ের দেশ। কেন এ দেশের ভিআইপিদের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে? আর কিছু চিকিৎসক বা নার্সের ব্যবহার—এগুলো ঠিক করতে কোনো স্বপ্ন লাগে না। ইচ্ছা হলেই হয়।
এরপর আসি খাদ্য নিয়ে। আমাদের এই সীমিত জমির মধ্যে কৃষকেরা প্রায় ১৬ কোটি মানুষের খাদ্য উৎপাদন করেন। আমাদের জনসংখ্যা গণনা ঠিক থাকলে খাদ্য আমদানিই লাগত না। জলবায়ু পরিবর্তন সত্ত্বেও তাঁদের সফলতা অনেক। বাস্তবতা হচ্ছে, তাঁদের আরও অনেক কিছু দেওয়ার আছে। এমন একটা দেশ চাই, যেখানে তাঁরা ন্যায্যমূল্য পান। সিন্ডিকেট ভেঙে দিলে তাঁরা ২০ কোটি মানুষের জন্যও ফসল উৎপাদন করতে পারবেন।
বস্ত্র নিয়ে বলতে গেলেই আসে আমাদের গর্ব গার্মেন্টসের কথা। কিন্তু এই বস্ত্র উৎপাদনের কাঁচামালও আনতে হয় বাইরে থেকে। কেন? আমরা তুলা এখানে উৎপাদন করতে পারি না? টেক্সটাইল খাত তো গার্মেন্টসের মতো শক্তিশালী নয়। একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ বস্ত্র খাতের স্বপ্ন দেখা কি খুব বাড়াবাড়ি?
এখন আসি শিক্ষা খাত। যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারা এই শিক্ষা খাত এখন দেশের চাহিদা মেটাতে পারছে? আমাদের তো সবার জন্য কর্ম নিশ্চিত করতে হবে। এমন একটা শিক্ষাব্যবস্থা দরকার, যেখানে আমাদের সবচেয়ে নিচের স্তর থেকে উপর স্তর পর্যন্ত সবখানে দেশের লোক দিয়েই হতে হবে। বাইরের লোক আর কত? সেই শিক্ষাব্যবস্থা স্বপ্ন দেখি, যা সবাইকে নিজ নিজ যোগ্যতায় কাজ করার সুযোগ দেবে।
সবার জন্য বাসস্থান একটা বড় স্বপ্ন। আর একটা বড় স্বপ্ন সুস্থ ঢাকা শহর তৈরি করা।
আমাদের দুই প্রধান দলের স্মার্ট বাংলাদেশ এবং রাষ্ট্র মেরামতের প্রস্তাবনাগুলো পূর্ণ হলেই কিন্তু হয়ে যায়। এখন সমস্যা হচ্ছে, আমাদের অতীত ও বর্তমান রাষ্ট্রযন্ত্র বাস্তবায়নে অদক্ষতা দেখিয়েছে। তাহলে কি হবে না? কেন হবে না—আমাদের সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বেসরকারি খাতের এবং বিদেশে থাকা অনেক বিশেষজ্ঞ আছে, আছে আমাদের দেশীয় গবেষক—সবাই যদি একসঙ্গে চায়, কেন স্বপ্নের দেশ হবে না?
আমাদের দূষণ নিয়ে অনেক কথা বলা হয়। অনেক দেশ আমাদের থেকে উন্নত অথবা অনুন্নত। কই, তাদের দূষণ তো আমাদের থেকে বেশি নয়? আর প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ করা গেলে জ্যামও অনেক কমে আসবে। চাইলে অনেক কিছুই করা সম্ভব।
আবশ্যক চাহিদা তো গেল। এখন দেখি আর কী চাহিদা অন্যদের আছে। দেশের সবকিছু স্মার্ট হবে। ডিজিটালের নামে এখন যা হচ্ছে, তা আমাদের কাজ দ্বিগুণ করে দিয়েছে। আমরা স্বপ্ন দেখি, সব অনলাইনেই হয়ে যাবে। আমাদের কষ্ট করে আর দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে হবে না। ছোট্ট উদাহরণ দিই। যেমন পাসপোর্ট। অনলাইনে আবেদন করার পর আবার কপি নিয়ে লাইনে দাঁড়াতে হয়। যেহেতু অনলাইনেই ভেরিফিকেশন সম্ভব, আমাদের উচিত শুধু ছবি তোলার জন্য যাওয়া। কিন্তু আবার ডকুমেন্ট নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করার তো মানে নেই! আমরা একটা আধুনিক জীবন চাই, যা আমাদের সবকিছু সহজ করবে।
সুশাসন, গণতন্ত্র আর ব্যক্তি ও বাক্স্বাধীনতা—গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে এগুলোর স্বপ্ন দেখলে কি পাপ হবে? সরকারি দুর্নীতি অনেক দেশ বন্ধ করতে পেরেছে, আমরা কেন পারব না? চাইতে হবে।
ব্যবসাবান্ধব পরিবেশের জন্য এমন একটা দেশ চাই, যেখানে ক্ষমতাধারীরা বা বড় ব্যবসায়ীরা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের খেয়ে ফেলবে না। দেশে অনেক উদ্যোক্তা থাকবে, পাচার বন্ধ করে ব্যবসায়ীরা দেশেই কারখানা করবে, দেশ হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ, থাকবে না বেকারত্ব। আমরা নিজেরাই নিজেদের খনি থেকে গ্যাস তুলব। লাগবে না আর এলএনজি আমদানি। অকটেনে হব স্বয়ংসম্পূর্ণ। ডিজেল আমদানির থাকবে অনেক উৎস। জ্বালানির জন্য কোনো ব্যবসার ক্ষতি হবে না।
সবকিছু অবাস্তব লাগছে? কিন্তু আমাদের দুই প্রধান দলের স্মার্ট বাংলাদেশ এবং রাষ্ট্র মেরামতের প্রস্তাবনাগুলো পূর্ণ হলেই কিন্তু হয়ে যায়। এখন সমস্যা হচ্ছে, আমাদের অতীত ও বর্তমান রাষ্ট্রযন্ত্র বাস্তবায়নে অদক্ষতা দেখিয়েছে। তাহলে কি হবে না? কেন হবে না—আমাদের সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বেসরকারি খাতের এবং বিদেশে থাকা অনেক বিশেষজ্ঞ আছে, আছে আমাদের দেশীয় গবেষক—সবাই যদি একসঙ্গে চায়, কেন স্বপ্নের দেশ হবে না?
আরও অনেক কিছুই লেখা যায়, আমি শুধু সেগুলোই লিখলাম, যা হয়তো চেষ্টা করলে সম্ভব। অনেক কিছু হয়তো বাদ পড়ে গেছে। আপনাদের স্বপ্নগুলোও চেষ্টা করেন বলতে। অনেক দেশে রচনা প্রতিযোগিতাও হয় নিজ নিজ দেশকে কেমন দেখতে চায়, আমাদের এটাও খুব বেশি হয় না। মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। আর কোনো লক্ষ্য না থাকলে কেউই এগোতে পারে না। তাই আমি-আপনি মিলে যদি লক্ষ্য ঠিক করি, নিজেদের সেভাবে বদলাই, আস্তে আস্তে আমাদের সমাজটাই বদলাতে পারে।
আমাদের সবার চাওয়াই হয়তো আমাদের সমাজের যে পাথর আছে, তা সরিয়ে ফেলবে। আমাদের পরের প্রজন্মের কাছে একটা বাসযোগ্য স্বাবলম্বী দেশ দিতে চাওয়া কি খুব বেশি চাওয়া?
বিস্তারিত পড়ুন প্রথম আলোতে