৩ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোতে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) বরাত দিয়ে বিসিএসে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরির করা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়েছে, বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্ররা বেশি সুবিধা পায় বিধায় পিএসসি প্রশ্নপত্রে বদল আনবে। এখন আমার প্রশ্ন, বিসিএসের কাজ কি মেধাবীদের সুযোগ দেওয়া, নাকি পথ বন্ধ করে দেওয়া?
‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ কথাটা এত দিন আমাদের রাজনীতিবিদদের মুখে মুখে থাকলেও প্রথমবারের মতো লেখায় এলো আমাদের কর্ম কমিশনের মুখে। বিসিএসে এখন প্রায় সাড়ে ৩ থেকে ৪ লাখের মতো পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন, যা এককভাবে প্রায় ৬০টি দেশের জনসংখ্যার থেকেও বেশি। আর একেকটা আসনের বিপরীতে ২২০–এর মতো অংশগ্রহণ থাকে, যার মানে প্রায় ২১৯ জনকে হতাশ হতেই হয়।
আচ্ছা, প্রথমেই দেখে নিই বিসিএসে কী পদ্ধতিতে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয়। সেখানে বাংলায় ৩৫, ইংরেজিতে ৩৫, গণিতে ১৫, মানসিক দক্ষতা ১৫, সাধারণ বিজ্ঞান আর আইসিটিতে ৩০, বাংলাদেশ বিষয়ে ৩০, আন্তর্জাতিকে ২০, ভূগোল পরিবেশ আর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ১০ এবং নৈতিকতায় ১০ নম্বর রাখা হয়েছে। এখানে বিজ্ঞান থেকে আসে ২০০–এর মধ্যে ৪৫, বাকি সব মানবিক বিভাগের অংশ। আবার লিখিত পরীক্ষায় বাংলায় ২০০, ইংরেজিতে ২০০, বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ২০০, আন্তর্জাতিকে ২০০, গণিতে ৫০, মানসিক দক্ষতায় ৫০, সাধারণ বিজ্ঞানে ১০০। এখানে বিজ্ঞান থেকে আসে মোট ১৫০। উভয় ক্ষেত্রেই গণিত আর সাধারণ বিজ্ঞান ধরা হয় মাধ্যমিক সমমানের, যা সব পরীক্ষার্থীকেই পড়ে আসতে হয়েছে। এখন একজন ক্যাডারের এ রকম ন্যূনতম জ্ঞানও কি থাকার দরকার নেই?
বিজ্ঞান বিভাগের মধ্যে দুটি অংশ—ফলিতবিজ্ঞান (যার মধ্যে আছে প্রকৌশল ও চিকিৎসাবিদ্য, ফার্মাসি, কৃষিসহ বিষয়গুলো) আর পিউর বিজ্ঞানের মধ্যে আছে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নসহ বিজ্ঞানের বিষয়গুলো। বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ফলিতবিজ্ঞানের মানুষজন সুবিধা পেলেও গবেষণা বা অন্যান্য বিষয়গুলোতে আদি বিজ্ঞানের বিষয়গুলোই এগিয়ে থাকে। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশে তাদের চাকরির সুযোগ মানবিক বিভাগ থেকে কোনো অংশেই বেশি নয়। ফলিতবিজ্ঞানের মানুষের জন্য তাদের ওপর অবিচার ও কাম্য নয়।
সরকারি চাকরিতে টেকনোক্র্যাট আর নন–টেকনোক্র্যাট দ্বন্দ্ব শুরু থেকেই ছিল। টেকনোক্র্যাটরা মূলত আসা এই ফলিতবিজ্ঞান থেকে যাঁরা নিজেদের ভালো ছাত্র দাবি করে এগিয়ে রাখতে চান, আর নন–টেকনোক্র্যাটদের দাবি, তাঁরা প্রশাসনিকভাবে দুর্বল। ২০১৬–এর আগে এটা খুব প্রকট ছিল না, কারণ তখন বেসরকারি চাকরি ছিল রমরমা, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও কম শিক্ষার্থী বের হতো, যারা পারত বিদেশে চলে যেত। আর যারা থাকত বেসরকারিতে উচ্চ বেতনে চলে যেত, আর অবশিষ্টরা সরকারি চাকরিতে গেলেও নিজের বিষয়ে থাকতে চেষ্টা করত। কিন্তু ২০১৬–এর পর টাকা পাচার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ার পর বেসরকারি খাত স্থবির হয়ে পড়ে, অনেক টেকনিক্যাল ছাত্রছাত্রীরা চলে আসে, বিদেশে স্কলারশিপও একটু কমে যায়। ফলে সরকারি চাকরি হয়ে ওঠে প্রথম লক্ষ্য। আগে সরকারি চাকরি ছেড়ে অনেকেই সেসরকারি চাকরি বা ক্রিয়েটিভ বা সৃজনশীল কাজে সফল হলেও এখন কেউ ছেড়ে আসবে, কল্পনা করাই পাপ।
এখন চলে আসা মিথ, টেকনোক্র্যাটরা কি প্রশাসনিক চালাতে দুর্বল? অবশ্যই না। পৃথিবীর ৭০ শতাংশ সিইও বা প্রধান নির্বাহী টেকনিক্যাল এবং বিজনেস গ্র্যাজুয়েশনের সমন্বয়ে চলা। দেশের সব থেকে সফল বিদ্যুৎ খাত পরিচালনা করছেন প্রকৌশলীরা, সরকারের সফল মন্ত্রণালয় চালাচ্ছেন একজন কৃষিবিদ, শিক্ষা মন্ত্রণালয় চালাচ্ছেন একজন চিকিৎসক। পৃথিবীর সব বড় হাসপাতাল বা জীবন রক্ষাকারী গবেষণা চালাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। আর বিশ্বের সব থেকে বড় অর্থনীতির দেশে চীনের ৮৫ শতাংশ মন্ত্রী টেকনোক্র্যাট, প্রধানমন্ত্রী শি চিন পিং নিজেও একজন প্রকৌশলী। তাহলে তাদের আটকানো কি জরুরি?
শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘বিসিএস বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে একটা বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হোক। সেখানে ‘প্রিলিমিনারি পরীক্ষা’, ‘ভাইভা’ ইত্যাদি নামে বিভাগ থাকবে। আসলেই বিভিন্ন লাইব্রেরিতে গেলে আমাদের শিক্ষার্থীদের যেভাবে বিসিএস আর ব্যাংকের চাকরির জন্য পড়তে দেখা যায়, এ রকম পড়াশোনা যদি গবেষণার জন্য করার সুযোগ থাকত, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাঙ্কিং আরও ভালো হতো। এখন যদি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের মাধ্যমে বিজ্ঞান বাদে অন্যদের সুযোগ বাড়িয়ে দেওয়া হয়, ভবিষ্যতে বিজ্ঞান পড়াতে অনীহা চলে আসতে পারে।
তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত আমরা যোগ্য প্রার্থী নেব নাকি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড করব। আমাদের দেশের সব থেকে সুষ্ঠু পরীক্ষা হয় আইবিএতে, যেখানে সবকিছুর সঙ্গে থাকে ‘অ্যানালিটিক্যাল অ্যাবিলিটি’। চাকরিতে এই জিনিস খুব দরকার। আর একটা দরকার গ্রামার–ভিত্তিক ইংলিশ পরীক্ষা থেকে সরে ভোকাবুলারি–ভিত্তিক ইংরেজি পরীক্ষা নেওয়া। আমাদের দেশের ছেলেরা ভোকাবুলারিতে অনেক পিছিয়ে, যা আমাদের বিশ্বের অন্য দেশের সঙ্গে যোগাযোগে পিছিয়ে দেয়। আমাদের আর্টস–কমার্সের ছাত্ররাই বিদেশে যাওয়ার জন্য জিম্যাট–সেট পরীক্ষা দিচ্ছে। আমাদের অবশ্যই পরীক্ষাপদ্ধতি সংশোধন করতে হবে, কিন্তু সেটা আধুনিক হওয়ার জন্য, কাউকে আটকানোর জন্য নয়।
পাশের দেশ ভারত ও ১৯২২ সাল থেকে চলে আসা প্রক্রিয়া অনেক হালনাগাদ করেছে। কোটা ব্যবস্থা বাতিলের পর পিএসসির আরেকটি ভালো সিদ্ধান্ত ভাইভা বোর্ডে আচার–আচরণ, পোশাক–পরিচ্ছেদ দেখা। অবশ্যই এটা জরুরি। এখন বিবিএ, এমবিএ–এর ছেলেরা এখানে সুযোগ বেশি পাবে বলে ভালো সিদ্ধান্তও কি আটকে দেওয়া হবে? বরং এই সিদ্ধান্ত আরও নিখুঁত করার জন্য সবার ইন্টারভিউ রেকর্ড করা উচিত আইএলটিএস পরীক্ষার মতো। যাতে পরীক্ষকও সতর্ক থাকে এবং পরীক্ষার্থীরাও প্রয়োজন বোধে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। সরকার আর একটা ভালো কাজ করতে পারে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫ করে দিয়ে। এটা এখন সময়ের দাবি। পিএসসি আরও বেশি আয় করতে পারবে বয়সসীমা বাড়ালে।
এখন দেখি কেন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের কথা এসেছে? ‘থ্রি ইডিয়ট’ মুভির মতোই আমাদের সমাজে জন্মের পরই সবার মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে হবে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার না হলে জীবন বৃথা। ফলাফল বেশির ভাগ মেধাবী ছেলেই বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার চেষ্টা করে। সায়েন্টিফিক বাংলাদেশের তথ্যমতে, বাংলাদেশের ২০২১ সালে ১০০০০+ জার্নাল প্রকাশিত হয়েছে, যার মধ্যে ৭ হাজারের মতো ফলিতবিজ্ঞানের এই অল্প কিছু বিষয়গুলো থেকে, বাকি ৩ হাজারের মতো হয়েছে পিউর সায়েন্স, আর্টস এবং কমার্সের শিক্ষার্থীদের কাছে থেকে। এটা আমাদের সিস্টেমের দৈন্য তুলে ধরে।
এখন অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, সরকার এত খরচ করে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বানিয়েছে, তাঁরা যদি নন–টেকনিক্যাল চাকরিতে যান, তাতে রাষ্ট্রের ক্ষতি কি না। অবশ্যই না। আমাদের দেশে এখন প্রয়োজনের চেয়ে বেশি টেকনিক্যাল মানুষ আছে। বিদেশ গিয়েও কিন্তু উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ছেলে বেকার আছে।
সমস্যা কোথায়? মহামারির আগে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ২৮টি দেশের মধ্যে উচ্চশিক্ষিত বেকারত্বের দিক থেকে বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে (বিবিসি ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২)। ধারণা করা হয়, দেশে প্রতিবছর ২০ লাখের বেশি জনশক্তি শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। যেখানে কর্মসংস্থানের মাত্র ৫ শতাংশ সরকারি খাতে আর ৯৫ শতাংশই বেসরকারি উৎসে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা ৭৮ শতাংশ শিক্ষার্থী নিজেদেরকে চাকরির জন্য প্রস্তুত ভাবছে না। ফলাফল পাস করা ৮২ শতাংশ ছাত্রছাত্রী বিদেশে চলে যাওয়াকে প্রাধান্য দিচ্ছে। এর সঙ্গে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার নানা সংকটও হাজির হয়। সেটির জন্য ভিন্ন আলোচনা করতে হয়।
এখন পরীক্ষার্থীদের প্রতি আমার ছোট্ট উপদেশ-বিসিএসের সঙ্গে সঙ্গে আইবিএ, এমবিএরও প্রস্তুতি নিয়ে রাখলে যেকোনো পরীক্ষার জন্য (ব্যাংকসহ) মোটামুটি প্রস্তুতি হয়ে যায়। দুটি কারণে বলছি, ওয়ারেন বাফেটের ঝুড়ি তত্ত্ব অনুসারে সব ফল এক ঝুড়িতে রাখতে হয় না। এবং এই প্রস্তুতি এবং জ্ঞান ভবিষ্যতে যেখানে চাকরি করবেন, কাজে লাগবেই। এলোমেলোভাবে না পড়ে প্ল্যান এ–বি–সি তিনটা রেখে, গুছিয়ে প্রস্তুতি নেওয়া উচিত।
বিস্তারিত পড়ুন প্রথম আলোতে