বেতন-ভাতার বাইরে কর্মীদের আর যা দিতে পারে বেসরকারি অফিস

বেসরকারি খাতের চাকরিজীবীদের জন্য এর আগে দুটি প্রবন্ধ লেখার পর মনে হচ্ছিল, দায় তো শুধু সরকার বা কর্মকর্তাদের নয়, অফিসও অনেক কিছু করতে পারে। কিন্তু ব্যবসার খারাপ সময়ে যখন সব সুযোগ কমে যাচ্ছে, তখন নিজেদের টিকে থাকার জন্যই মানবসম্পদের ওপর জোর দেওয়া সময়ের দাবি।

একটা প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে মানবসম্পদ। সুখী কর্মচারীরাই একটা সুখী অফিস দিতে পারে। আপনি পার্থক্যটা বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি রেভিনিউ জেনারেটর করা বিদেশি কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, ইউনিলিভার, গ্রামীণফোনের সঙ্গে দেশি লস প্রজেক্টে থাকা কোম্পানি (নাম বলছি না) ঘুরে এলেই টের পাবেন। একদিকে প্রাণবন্ত টিম, অন্যদিকে মনে হবে ২০ কেজি ওজন কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো মানুষ।

বাংলাদেশে একটা কথা আছে—টাকা থাকলে লোক পাওয়া যাবে। কিন্তু অনেক কোম্পানি তার কোর টিম হারিয়ে বসে পড়ার উদাহরণ ভূরি ভূরি। কোম্পানির বুঝতে হবে, নিজেদের সেটআপের টিম রেখে তাদের মানোন্নয়ন করে চলবে, নাকি বাইরে থেকে নিয়ে আসবে। নিজেদের সেটআপ ডেভেলপ করলে কিন্তু কেউ চলে গেলেও কাজ বসে থাকে না। আবার বাইরে থেকে লোক আনলে এর খরচও কিন্তু বেশি হতে পারে।

বিদেশি বিভিন্ন টেক কোম্পানি, যেমন ওরাকল, ফোরডসহ অনেক কোম্পানি কর্মী ছাঁটাই করছে। বেশির ভাগই তাদের রিসার্চ উইংয়ে। আমাদের দেশেও ছাঁটাই চলছে। কিন্তু আমাদের রিসার্চ উইং নেই-ই। অপারেশনাল টিমের কর্মী ছাঁটাই করে ভয়ের রাজত্বে বাস না করিয়ে বরং সাহস দিলে ভালো আউটপুট পাওয়া সম্ভব। চলুন দেখি কী করা যায়।

বেতন কাঠামো পুনর্গঠন করুন

আমাদের দেশের সবাই শুধু কতগুলো টাকা হাতে পাওয়া বা অ্যাকাউন্টে যাওয়াকে বেতন মনে করে। কিন্তু কোম্পানির আরও খরচ আছে কর্মচারীদের জন্য। সব খরচ উন্মুক্ত করে দেখতে দিন, বাইরের দেশে যেটি সিটিসি (কস্ট টু দ্য কোম্পানি), সেই ধারনা নিয়ে আসুন। সব বছর অন্য খরচ, যেমন ইনস্যুরেন্স, প্রভিডেন্ট ফান্ড, বোনাস, ট্যাক্স সব নিয়ে আসুন, কর্মচারীরাও নিজেদের ভ্যালু জানুক। এটার দুটি সুবিধা—কর্মকর্তা–কর্মচারীরা অবগত হলো এবং করফাঁকিও কমে আসবে। (সরকারি খাতে এটা চালু করা সময়ের দাবি। তাদের বেতন বলতে শুধু বেসিক দেখানো হয়, সব মিলিয়ে সিটিসি ধরলে তা মূল বেসিকের অনেক বেশি হবে, আর এটা আমাদের জানার অধিকার আছে)।

প্রশংসা করুন

কালচারটা আমাদের দেশে বিরল। ইউনিলিভারের সিইওর একটা চিঠি দেখেছিলাম। তিনি তাঁদের মাসসেরা কর্মীর মা-বাবাকে চিঠি লিখেছেন। ছোট্ট একটা কাজ—কী পরিমাণ ভূমিকা রাখে ভাবতে পারেন? এই সঙ্গে অধীনস্থদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করুন। কাজ শেষে ‘ধন্যবাদ’ দিলে পিয়নও খুশি হয়।

ইনস্যুরেন্স করে দিন

এখন বাজারের যা অবস্থা, সবাই নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে অস্থির। চিকিৎসা নিয়ে ভাবার সময় কোথায়? অনেক ভালো কোম্পানির হসপিটালাইজেশন পলিসি আছে। এখন এই খাতে বাজেট না করে ইনস্যুরেন্স কোম্পানির ওপর ছেড়ে দিন, যেটা সারা পৃথিবীতে চলছে। হ্যাঁ, বাংলাদেশে একটা কথা আছে, ইনস্যুরেন্স কোম্পানি থেকে টাকা পাওয়ার ইনস্যুরেন্স কোথায়? হালের সাধারণ বিমার ঘটনা আরও ভয় দেখায়। কিন্তু কিছু তো ভরসা করতেই হবে। এর ফলে আপনার অধীনস্থরা ভরসা পাবে, হয়তো ইনস্যুরেন্স কোম্পানিগুলোও নিজেদের ঠিক করবে।

একজন যত বেতন আশা করে, এর চেয়ে অল্প কিছু বাড়িয়ে দিয়ে নিয়োগ দিলে তার কাছ থেকে অনেক বেশি সহযোগিতা পাওয়া যায়। তেমনি সরকার থেকে ঠিক করে দেওয়া প্রফিট শেয়ার চালু করা হয়, সেই প্রফিটের জন্য আরও বেশি কাজ করবে কর্মীরা। মূল্যস্ফীতির এই সময়ে সবারই দাবি বেতন বাড়ানোর, কিন্তু অনেকের জন্য বিষয়টি কঠিন। এর মধ্যে চট্টগ্রামের এক কোম্পানি তাদের কয়েক হাজার কর্মীর বেতন বাড়িয়েছে। এমন উদাহরণও আছে।

মুক্ত পরিবেশ তৈরি করুন

আমাদের দেশের ফ্রি স্পেস মানেই বাইরে বেরিয়ে চা-সিগারেট খাওয়া। কিন্তু প্রতি ২ ঘণ্টা কাজের পর ৫ থেকে ১০ মিনিট ব্রেক বা বিরতি, লাঞ্চের পর ১৫ মিনিট বিরতি কাজের সক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। গুগলের অফিস দেখলে মনে হবে ওইখানে সবাই রিলাক্স করতেই যেন গেছে। ক্লান্ত মস্তিষ্কের থেকে সজীব মস্তিষ্ক অনেক কাজ সহজ করে দেয়। তাই একটা ফ্রি স্পেস খুব জরুরি। হয়তো পুরো বিল্ডিংয়ে একটা কিছু ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটি থাকতে পারে, আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চাইল্ড কেয়ার। এটা আমাদের দেশের মেয়েদের অনেক শান্তিতে কাজ করার সুযোগ দিতে পারে।

উন্নতির সোপান দেখানো

একজন জুনিয়র পোস্টে জয়েন করলে সেই কোম্পানির সিইও হিসেবে যেন চাকরিজীবন শেষ করতে পারে, এ রকম পথ খোলা রাখতে হবে। উন্নতির পথ খোলা রাখলে মানুষ চেষ্টা করে ওঠার। যখন পারে না, অন্যদিকে চলে যায়। লাভটা সেই জুনিয়রেরই হয়।

বেতন–বোনাস

নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, একজন যত বেতন আশা করে, এর চেয়ে অল্প কিছু বাড়িয়ে দিয়ে নিয়োগ দিলে তার কাছ থেকে অনেক বেশি সহযোগিতা পাওয়া যায়। তেমনি সরকার থেকে ঠিক করে দেওয়া প্রফিট শেয়ার চালু করা হয়, সেই প্রফিটের জন্য আরও বেশি কাজ করবে কর্মীরা। মূল্যস্ফীতির এই সময়ে সবারই দাবি বেতন বাড়ানোর, কিন্তু অনেকের জন্য বিষয়টি কঠিন। এর মধ্যে চট্টগ্রামের এক কোম্পানি তাদের কয়েক হাজার কর্মীর বেতন বাড়িয়েছে। এমন উদাহরণও আছে।

সরকার বিদ্যুৎ খরচ কমানোর জন্য অফিসের সময়সূচি বদলে ফেলেছে। বেসরকারি খাত নিয়ে কোনো কথা হচ্ছে না। ব্যাংক বাদ দিলেও অবশিষ্টরা মোট চাকরিজীবীর ৮৫ শতাংশের কম হবে না। অফিসের সময়সূচি বদলে ফেলে খুব কি লাভ হলো, নাকি সবার একসঙ্গে সমন্বয় করলে সবচেয়ে বেশি লাভ হতো? এখন তো এই খাতের অফিস টাইম আরও বেড়ে গেল। আগের লেখার ধারাবাহিকতাই বলি, রোববার সাপ্তাহিক ছুটি করলে সবারই লাভ বেশি হয়।

আরেকটা কথা, নিয়োগের সময় বন্ড সাইন করে রাখা, ব্ল্যাঙ্ক চেক সাইন করিয়ে রাখা বা সার্টিফিকেট জমা রাখা—এসব অবৈধ কাজ বাদ দিতে অনুরোধ করছি। অনেক বড় দেশি কোম্পানিকে এ কাজ করতে দেখি, যা বাংলাদেশের আইন অনুসারে পুরোপুরি অবৈধ।

পরিশেষে ব্যবসায়ীদের প্রতি—সারা পৃথিবী এখন কালোটাকার ওপর সোচ্চার, মূল্যস্ফীতি এখন ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমিয়ে দিচ্ছে, বসে খেলে রাজার ভান্ডারও শেষ হয়। যাঁরা বিদেশে টাকা পাঠিয়েছেন, এখন যদি ফিরিয়ে নিয়ে আসেন, ক্রাইসিসের জন্য অনেক ব্যবসার সুযোগ আছে, সরকার ও সুযোগ দিচ্ছে, যা আপনারা নিতে পারেন। নিজের দেশে সব জিনিসের প্রোডাকশন প্ল্যান করার এখনই উপযুক্ত সময়। রেখে দিলে লাভের গুড় পিঁপড়ায়ও খেয়ে দিতে পারে। আর সব শেষে, দেশটা তো আমাদের সবারই।

বিস্তারিত পড়ুন প্রথম আলোতে

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top