গতকাল সোমবার উত্তরায় ক্রেন দুর্ঘটনায় গার্ডার চাপা পড়ে পাঁচজনের মৃত্যু ঘটে।
উত্তরার ঘটনায় সবাই খুব মর্মাহত। চারদিকে সবাই বিভিন্ন কারণ খুঁজছে। ফেসবুকে অনেক ভুল অ্যানালাইসিসও দেখছি। উন্নয়ন প্রকল্পে এ ধরনের মৃত্যু নতুন নয়। ক্রেন নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে ক্রেনের মালিক ও কাস্টমারদের অনেক দিন ধরেই সমস্যা নিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলেও বেশির ভাগ চেষ্টাই লব ডঙ্কা। এখানে মূল সমস্যাটিই অনেকের কাছে স্পষ্ট নয়, ফলে সমাধানের বিষয়টি গুরুত্ব পায় না।
ক্রেন দিয়ে কোনো প্রজেক্টের কাজকে ‘হেভি লিফট অপারেশন’ বলা হয়। হেভি লিফট টেকনোলজির বিকাশ শুরু সেই পিরামিডের পাথর তোলা থেকে, যা এখন আধুনিক বিশ্বে ক্রেন এবং অন্যান্য ইকুইপমেন্ট দিয়ে হচ্ছে। বিদেশে যা একটা পুরাই আলাদা ডিপার্টমেন্ট। আর বাংলাদেশে তা মেকানিক্যালের একটা অংশ।
আমাদের সবার একটা ধারণা—৫০ টন ক্রেন দিয়ে ৫০ টন তুলে ফেলা, এটা তো খুব সহজ ব্যাপার। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, একটা ক্রেন কতটুকু তুলতে পারবে, তা অনেক প্যারামিটারের ওপর নির্ভর করে—কত ওজন, ক্রেনের সেন্টার থেকে কতটা দূরে আছে, কত উঁচুতে তুলতে হবে, আর যে জিনিসটা তুলতে হবে, তার আকার কত। কম ওজনের মালের ক্ষেত্রে সব ক্রেনের সঙ্গে একটা লোড চার্ট আছে, যা দেখে অপারেটর তুলে ফেলতে পারে। কিন্তু বড় কোনো ওজনের ক্ষেত্রে হলে লিফটিং ও রিগিং ড্রয়িং অবশ্য কর্তব্য। এই ডিজাইন ও হিসাবের মধ্যে আরও চলে আসে ক্রেন শতকরা কত ক্ষমতায় কাজ করছে, মাটির ভর নেওয়ার ক্ষমতা, মাটি লেভেল করা আছে কি না, এ রকম যত নিরাপত্তামূলক প্যারামিটার আছে সব। বাংলাদেশ এখানেই দুর্বল।
ইউরোপিয়ান, জাপানি বা কোরীয়রা এই হিসাব করে কাজ করলেও বাকিরা এখানে নীরব। বাংলাদেশে সব থেকে বেশি ক্ষমতার ক্রেন আছে ১ হাজার ৩৫০ টন, যা বিশ্বে এখন ৫ হাজার টনের মতো। উত্তরার এই ওজন বহনের কোনো লিফটিং ডিজাইন কি ছিল? থাকলে কখনোই এত বড় ঘটনা ঘটা সম্ভব নয়। লিফটিং ড্রয়িং ছাড়াও থাকতে হবে নিরাপত্তাবেষ্টনী, যা এখানে অনুপস্থিত। এখন কি এটাকে নিছক দুর্ঘটনা বলা সম্ভব? যা ঘটেছে, তা মোটেও ‘মেকানিক্যাল ফল্ট’ নয়।
পত্রপত্রিকায় দেখছি, এর আগেও পায়রা ব্রিজ, রূপপুর, মগবাজার ফ্লাইওভার, গাজীপুরে বিআরটি প্রজেক্ট, রামপালসহ বেশ কিছু জায়গায় ক্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে মানুষের মৃত্যুও ঘটেছে। একটা প্রজেক্টের সব থেকে বিপজ্জনক কাজ হচ্ছে হেভি লিফট অপারেশন, যা পুরো প্রজেক্টের ১০-২০ শতাংশ খরচ—ভারী মাল পরিবহন আর জায়গামতো বসানোর কাজ। কিন্তু এই বিষয়টির দিকে আমাদের তেম নজর নেই বললেই চলে। ফলে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে।
হেভি লাইসেন্স পাওয়া অনেক কঠিন করে রাখায় লাইসেন্স নকল হচ্ছে। এ ব্যাপারে বিআরটিএর উচিত সময় কমিয়ে নিয়ে আসা। আমাদের অনেক দক্ষ অপারেটর আছেন, যাঁরা মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করে এসেছেন। তাঁরা এই লাইসেন্সের জন্য কাজ করতে পারেন না। যাঁদের বিদেশি লাইসেন্স আছে, তাঁদের সরাসরি হেভি লাইসেন্স দিলে ক্রেনের দক্ষ অপারেটর–সংকট কমে যেত।
কেন এত সমস্যা
১. আমাদের নিজেদের টেকনিক্যাল জ্ঞান একেবারেই নেই। সারা দেশে ৪০০–এর ওপরে ক্রেন চলে, কিন্তু লিফটিং আর রিগিং প্ল্যান কজন করতে পারেন, এমন কজন আছেন? যদি থাকেন, তাঁদের বিদেশে চাকরি পাওয়া খুব সহজ। অদক্ষতা সব জায়গাতেই।
২. আমাদের দেশে যে বিদেশিরা আসেন, তাঁরা বেশির ভাগই অদক্ষ। তাঁরা যেকোনো উপায়ে খরচ কমিয়ে কাজ করে ফেলতে চান। তাঁরা এ ব্যাপারে চাপও তৈরি করেন, ফলে যেনতেনভাবে কাজ সম্পন্ন করার চেষ্টা থাকে।
৩. আমাদের দেশের বেশির ভাগ ক্রেনের ফিটনেস নেই। সব ক্রেনের জন্য সেফ লোড ইন্ডিকেটর থাকা আবশ্যক, যা ওভার লোড হলে সিগন্যাল দেয়, অনেক ক্রেনেই তা অনুপস্থিত। নিয়মিত ক্রেন মেইনটেন্যান্সও হয় না। ফলে যেকোনো সময় বড় কিছু ঘটে যেতে পারে।
৪. পেপার জালিয়াতি আর রং করে অনেক বাতিল ক্রেনকে নতুন করে প্রকল্পগুলোতে দেওয়া হয়। এ ছাড়া অপারেটরের লাইসেন্স বানিয়ে দেওয়া হয়। বিদেশিদের পক্ষে এই জালিয়াতি ধরা অসম্ভব।
৫. সেফটি বলে যে একটা জিনিস আছে, তা জাপানি, কোরীয় বা রাশিয়ান প্রকল্প ছাড়া একেবারেই হিসেবে রাখা হয় না। সরকার থেকেও কোনো মনিটরিং নেই।
৬. আজ পর্যন্ত কোনো দুর্ঘটনায় অবহেলাকারীর বিচার দেখা যায়নি।
৭. বাংলাদেশের বেশির ভাগ ক্রেন ভাড়ায় চলে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে (যারা অধিকাংশ সময়েই সরকারঘনিষ্ঠ, আর প্রজেক্টে অবাধ যাতায়াত থাকে)। তাদের কাছে টাকাই আসল, বাকি কিছু নিয়ে তাদের কোনো আইডিয়া নেই, আর মালিকপক্ষও বুঝতে পারছে না, তাদের ক্রেন কী কী কাজ করছে।
৮. বাংলাদেশে মানসম্পন্ন স্পেয়ার পার্টস আর লিফটিং ম্যাটারিয়ালস অপ্রতুল। তোলার সময় ছিঁড়ে গিয়ে লোড পড়ে মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনাও আছে।
৯. কাজের সময় কাজ দেখার জন্য নিচে দাঁড়িয়ে থেকেও মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে।
সমাধান কী
সরকারকেই গাইডলাইন দিতে হবে, কীভাবে কোয়ালিটি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। একটা সেফটি গাইডলাইন আছে, যা আপডেট করা সময়ের দাবি। এ ব্যাপারে অবশ্যই বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া উচিত। হেভি লাইসেন্স পাওয়া অনেক কঠিন করে রাখায় লাইসেন্স নকল হচ্ছে। এ ব্যাপারে বিআরটিএর উচিত সময় কমিয়ে নিয়ে আসা। আমাদের অনেক দক্ষ অপারেটর আছেন, যাঁরা মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করে এসেছেন। তাঁরা এই লাইসেন্সের জন্য কাজ করতে পারেন না। যাঁদের বিদেশি লাইসেন্স আছে, তাঁদের সরাসরি হেভি লাইসেন্স দিলে ক্রেনের দক্ষ অপারেটর–সংকট কমে যেত।
অপারেটরদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা উচিত। যে বিদেশিরা এ দেশে আসবেন, তাঁদের ন্যূনতম যোগ্যতা থাকা উচিত। সব অবহেলার তদন্তগুলো ফাইলবন্দী না করে বিচার করা উচিত। অবহেলাজনিত খুন অবশ্যই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আর একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে, ক্রেনের মেইনটেন্যান্স নিশ্চিত করা। আমি ভারতে একটা জার্মানির তৈরি ক্রেন দেখেছিলাম ১৯৮৪ সালের, যা বাংলাদেশের দুই বছরের পুরোনো চীনা ক্রেনের থেকে অনেক ভালো পারফর্ম করে, শুধু মেইনটেন্যান্সের জন্যই।
এ দেশে কাজ করা ইউরোপিয়ান বা জাপানি ক্রেন কোম্পানিগুলো দেশীয় লোকবলের মাধ্যমে সেফটি আর কোয়ালিটি মেনে কাজ করতে পারলে অন্যরা কেন পারবে না? একটা আইডিয়া দিই—জার্মান মেড ক্রেনের পে ব্যাক পিরিয়ড আসে ১৫ বছরে, যেখানে চীনা ক্রেনের তিন বছরেই হয়ে যায়। আর জাপানি বা কোরীয় প্রজেক্ট সময় মেনে শেষ হয়। অন্যরা, যাদের কাজে সেফটি পাত্তা পায় না, তাদেরই কিন্তু সময় বাড়ানো লাগে। তাই সবকিছুতেই দেশি লোকদের সঙ্গে সঙ্গে অদক্ষ বিদেশিরাও সমান দায়ী।
একটা কথা, যেখানে দুর্ঘটনা ঘটল, তার এক কিলোমিটারের মধ্যে ফায়ার সার্ভিস, এয়ারপোর্টের ক্রেন ছিল। তা–ও উদ্ধার করতে তিন ঘণ্টা কেন লাগল? নিজের অভিজ্ঞতায় বলি, আইডিয়াল কন্ডিশনে এই লোকেশনে ইমার্জেন্সি কাজ হিসেবে আধা ঘণ্টার বেশি লাগে না। আমরা হয়তো শিশু দুইটিকে বাঁচাতে পারতাম। সিদ্ধান্তহীনতায় আর অদক্ষতায় কত মানুষের প্রাণহানি ঘটছে, এ দায়ভার কার? অন্যান্য সাইটে যে শ্রমিকেরা মারা গেছেন, তাঁদের পরিবারদের কে দেখছে?
এ ঘটনা আমাদের শিক্ষা দিল, আমরা কোনো দুর্ঘটনা পূর্ববর্তী প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে পারি না, ঘটনা পরবর্তীও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। এত এত উন্নতির মধ্যেও আমরা এখনো নিজেদের নব্বইয়ের দশক থেকে তেমন বেশি এগিয়ে নিতে পারিনি। যেখানে জীবনের দাম নেই, সেখানে আসলে সবকিছুই অবান্তর।
বিস্তারিত পড়ুন প্রথম আলোতে