বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা যুক্তরাষ্ট্রের কথা আসলেই আমরা এক বাক্যে শুনি – ওরা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধী ছিলো। চীনও বিরুদ্ধে ছিলো – কিন্তু তা নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য শুনি না। যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সাপোর্ট দিয়েছে, কিন্তু তা কি ‘মাউথ সার্ভিসে’র থেকে বেশি ছিলো? আর তারা কি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলো, নাকি রক্তক্ষয় কমানোর চেষ্টায় ছিলো? আমি ওই সময়টাতে তাদের অবস্থান তাদের চোখ দিয়ে সংক্ষিপ্ত রুপে পাঠকের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। কারন তারা সেই সময়ে চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্র চুক্তিতে যাচ্ছিলো যার দুতিয়ালী করছিলো পাকিস্তান। তাই তারা কোন ভাবেই পাকিস্তানকে সরিয়ে দিতে পারছিলো না। ১৯৭১ সালের ২৮ শে ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদুত জোসেফ এস. ফারল্যান্ড শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করতে এসেছিলো। সেই সময়েই শেখ মুজিবুর রহমান সবকিছু যাতে স্বাভাবিকভাবে হয় ফারল্যান্ডের কাছে সেই সহায়তা চান। ২২ শে ফেব্রুয়ারির কিসিঞ্জারের মেমোতেই দেখা যায় – তিনি ধারনা করছিলেন শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষনা দিতে পারেন। তিনি ধারনা করেন – স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় সম্ভবত হচ্ছে। এবং শেখ মুজিব যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বন্ধু ভাবাপন্ন এবং উনাকে দরকার হবে যখন সত্যিই সত্যিই পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হবে [১,২]। ১ মার্চ নিরাপত্তা পরিষদের দুই সদস্য হ্যারল্ড সন্ডারস এবং স্যামুয়েল হজকিনসন একটা মেমো লিখেন কিসিঞ্জারকে। যেখানে লেখা হয় যে “আমরা সবাই এশিয়ার অস্থির অঞ্চলে ৭ কোটি মানুষের একটা সম্ভাব্য জাতিরাষ্ট্রের জন্ম দেখতে পাচ্ছি যেখানে আমরা নিয়ন্ত্রক নই। এই সম্ভাব্য জন্ম কিভাবে হবে – শান্তিপূর্ণ না রক্তক্ষয়ী সে বিষয়ে হয়তো আমরা কিছু করতে পারতাম“ [১]। কিসিঞ্জারের এক সাক্ষাৎকারে জানা যায় – নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের অনুরোধেই পাকিস্তান বাংলাদেশে স্বাধীনতা দিতে রাজি হয়। কিন্তু চায়নার সাথে সম্পর্কের জন্য আমেরিকার এ ইচ্ছা থাকলেও অনেক কিছু করতে পারে নাই [২]।
আমেরিকা এর ভিতরেই তাদের এই অবস্থানের বিপক্ষে মতামত জেগে উঠে- যার শুরু হয় ১৯৭১ সালেই শুরু হয় ঢাকায় নিযুক্ত কনসাল আরচার ব্লাডের টেলিগ্রাফ বার্তায়। যেখানে উনি সরাসরি ইউ এস স্ট্র্যাটেজীর সমালোচনা করেন এবং আওয়ামী লীগকে পশ্চিমা পন্থী দল হিসেবে উল্লেখ করেন। এদিকে ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্সের মেজর হান্ট ২৬ শে মার্চ পাকিস্তানের হামলার পর বলেছিলো আমেরিকা এখন উভয় সংকটে পড়লো [১]।
২৮ শে এপ্রিল প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে গোপন মেমোতে তিনটা অপশন দেয়া হয়।
১) প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তানকে বশে নেয়ার জন্য যে সামরিক বা রাজনৈতিক কর্মসুচী নিবে তার প্রতি সমর্থন বজায় রাখা (যার সুবিধা পাবে পশ্চিম
পাকিস্তান)।
২) সত্যিকারের নিরপেক্ষতা বজায় রাখা (যার সুবিধা পাবে পূর্ব পাকিস্তান)
৩) যুদ্ধ বন্ধে আন্তরিকভাবে উদ্দ্যেগ নেয়া হবে। যা হবে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসনের মধ্যবর্তী সময়।
নিক্সন প্রচলিত বয়ানের ১ নং অপশন না নিয়ে তিন নং অপশন নিয়েছিলো যাতে একটা রাজনৈতিক সমাধান নেয়া যায় এবং নিজ হাতে লিখেছিলো- ইয়াহিয়াকে যেন সব দিকে চেপে না ধরা হয় [১,২,৩]।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আমেরিকা কি পাকিস্তানকে অস্ত্র দিয়েছিলো? বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধের সময় আমেরিকার অবস্থান ছিলো – যেহেতু রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে – পাকিস্তানকে প্রানঘাতী অস্ত্র দেয়া যাবে না। এমনকি ওদের অনুরোধ সত্ত্বেও আর্মড পার্সোনেল ক্যারিয়ারও দেয়া হয় নাই [১,২,৩]। ২৫ শে মার্চের পর সিদ্ধান্ত ছিলো প্রানঘাতি নয় এমন সরঞ্জাম এবং যন্ত্রাংশ সরবরাহ অক্ষুন্ন থাকবে। কিন্তু অবাক করার বিষয় হচ্ছে ৯ই এপ্রিল সিআইএ এক গোপন সভাতে পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষুদ্র মরণাস্ত্র দেয়ার প্রস্তাব করে। পাকিস্তানীরা অস্ত্র না পেলেও বাংলাদেশ কিছু অস্ত্র পেয়েছিলো [২]।
কিসিঞ্জার ৩রা জুন একটা সভায় স্বীকার করেন যে উনার ধারনা বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। তিনি নিক্সনের ইয়াহিয়ার প্রতি বিশেষ অনুরাগের উপরও বিরক্তি দেখান [১]।
আওয়ামী গনপরিষদের সদস্য কাজী জহিরুল কাইয়ুম জুলাই মাসে চতুরপক্ষীয় আলোচনার প্রস্তাব দেন যেখানে আওয়ামী লীগ, আমেরিকা, ভারত এবং ইয়াহিয়া থাকবে। এবং অবশ্যই শেখ মুজিবকে যে আলোচনা সভাতে মুক্তি দিয়ে আনতে হবে। উনি বিশ্বাস করতেন যে মুক্তিযুদ্ধ প্রলম্বিত হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই।[১,২] পরবর্তীতে এই আলোচনাতে খন্দকার মুশতাক বা তাজউদ্দীন আহমেদ রাজী না হলেও নজরুল ইসলাম কথা বলতে চান। কিন্তু ভারতের না রাজির জন্য এই আলোচনা আর হয় নাই। [১]এখানে একটা মুল্যায়ন খুব উল্লেখ যোগ্য যে কিছু বাংলাদেশের নেতা মনে করেছিলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা ভারতের স্বার্থই রক্ষা করবে। [২]আর আমেরিকা যদি সাহায্য না করে, তাহলে বামপন্থীরা নেতৃত্বে চলে আসতে পারে।[১]
এদিকে ১৫ই জুলাই আমেরিকার প্রতিনিধি পরিষদের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটি গালাঘর সংশোধনী নামে এক বিল পাশ করে যার মাধ্যমে পাকিস্তানের সব আর্থিক এবং সামরিক সহায়তা (খাদ্যছাড়া) রহিত করে এবং ইউ এস প্রেসিডেন্টের উপর স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফিরিয়ে আনতে চাপ প্রয়োগ করে। সিনেটের পররাষ্ট্র কমিটি পরে একই ধরনের সংশোধনী আনে [১,৩]।
১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের ১১ই আগস্ট এক মিটিং এ ইউ এস সিদ্ধান্ত নেয় পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থী এবং দুর্গতদের যথাসাধ্য সাহায্য করবে। এখানে দেখা যায় আমেরিকা ভারতকে শরনার্থীদের জন্য ১০ কোটি ডলার দিয়েছে, এছাড়া ইউ এনের মাধ্যমে দেয়া ১৭০ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে ৭০ মিলিয়ন ছিলো আমেরিকার। এছাড়া বেসরকারী ভাবে আরও সাহায্য করা হয় [২,৩]। এছাড়া তারা যাতে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ যাতে শুরু না হয়, সেই চেষ্টা রাখার সিদ্ধান্ত নেয় এবং পাকিস্তানের এম্বাসেডর ফারল্যান্ডের মাধ্যমে ইয়াহিয়াকে জানিয়ে দেয়া হয় শেখ মুজিবকে যেন হত্যা না করা হয়। শেখ মুজিব যাতে যথার্থ আইনের সহায়তা পায়, এবং সামরিক আদালতে তার বিচার না করে- এই বার্তা আর ও কয়েক বার দেয়া হয় [২]। তারা এই মিটিং এর পর থেকেই সেই আগের তিন অপশনের ২য় টিতে চলে আসে যেখানে প্রকাশ্যে নিরপেক্ষ কথা বললেও রাজনৈতিক সমাধানের চেষ্টা শুরু করে, যা আসলে আওয়ামী লীগের ও সেই সময়ের চাওয়া ছিলো।
আমেরিকা বেশ শক্ত ভাবেই রাজনৈতিক সমাধানের চেষ্টা করে। কিন্তু ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের সাথে আলোচনাতে বসতে না চেয়ে বরং ২৭ শে ডিসেম্বর বেসামরিক প্রশাসনের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে চায় [৩]। ভারত প্রথম দিকে সংবিধানের মধ্যে আলোচনাতে রাজী থাকলেও পাকিস্তান ছাড় দেয় নাই।[২] কিসিঞ্জার নিক্সনকে এক জায়গাতে বলে ভারতের মনে একটা ভয় আছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে পশ্চিম বংগও ১০ বছরের মধ্যে স্বায়ত্তশাসন চাইতে পারে। [১] এই ব্যাপারে তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথেও কথা বলে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পাকিস্থানের অবস্থা দেখে খুব আগ্রহ দেখায় নি। ভারত ও পরে এই অবস্থান থেকে সরে আসে। এখানে একটা ডকুমেন্টে দেখা যায় ইয়াহিয়া বাংলাদেশ স্বাধীন হলে শুধু ভারত না, চীনের সুবিধার কথা ও বলে। চীন এই অংশে ছড়ি ঘুড়ানোর সুযোগ পেয়ে যাবে। পরবর্তীতে দেখা যায়, চীন পাকিস্তানের জন্য নিরাপত্তা পরিষদে থাকলেও বাস্তবে লীপ সার্ভিসের বেশি দেয় নি [১]।
ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয় ৩রা ডিসেম্বর। আমেরিকা যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদে তুলে ৪ঠা ডিসেম্বরে যা সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোর জন্য বাতিল হয়। যেখানে লক্ষ্যনীয় ব্রিটেন এবং ফ্রান্স ও ভোট দানে বিরত ছিলো[১]। ৭ তারিখে সি আই এই সহ একটা মিটিং হয়। যেখানে বলা হয় এই যুদ্ধ আর ১০ দিনের মতো চলতে পারে [২]। সেখানে কথা উঠে ভারতের উদ্দ্যেশ্য নিয়ে। ভারতের নিজেদের একটা মিটিং নিয়ে কথা হয়- যেখানে কাশ্মীরে ভারত দখল করার কথাও আলোচনাতে থাকে। যদি ও ইন্দিরা গান্ধী সেই সিদ্ধান্ত নেন নি, কিন্তু জেনারেলদের প্রেসার ছিলো [১]। সেই উদ্দেশ্য ঠেকানোর জন্য চীনকে সীমান্তে সেনা সমাবেশের অনুরোধ করা হয় (চীন এই কাজ করে নাই) এবং সপ্তম নৌ বহর পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয় [১,২], যা ভারত – সোভিয়েত রাশিয়ার কাছে তথ্য হিসেবে দেয়া হয় যে আমেরিকা বন্দর দখল করে নিতে পারে। কিন্তু আমেরিকার এটা আসলে লক্ষ্য ছিল না, তাদের অন্য়তম লক্ষ্য ছিলো পশ্চিম পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষা এবং তার জন্য যুদ্ধ বন্ধ করা। এই যুক্তি মেনে নেয়ার আরো একটা কারন পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ১০ ডিসেম্বরেই জাতিসংঘের কাছে ৬ দফার মধ্যে আত্মসমর্পনের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু আমেরিকা জাতিসংঘের মাধ্যমে না যেয়ে সরাসরি আত্ম সমর্পণের সিদ্ধান্ত দেয়, নইলে জাতিসংঘের প্রসেসে গেলে আমাদের স্বাধীনতার পেতে সময় লাগতো, এবং নতুন সমস্যা উদয় হতে পারতো। ফলে ভারতের সাথে আলোচনার করে সিদ্ধান্ত হয় বিমানবন্দরে হামলা বন্ধ থাকবে এবং ঢাকাতে কিছু সময়ের জন্য বিমান আক্রমন বন্ধ থাকবে [২]। ১০ ই ডিসেম্বর নিক্সন ব্রেজনেভকে কড়া ভাষাতে চিঠি লিখে পাকিস্তান আমেরিকা ১৯৬২ সালের চুক্তির কথা মনে করিয়ে অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করতে বলেন। যার আসল লক্ষ্য ভারতকে সংযত করা। এই সময়ে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার জন্য ও জর্ডান এবং ইরান থেকে যুদ্ধবিমান পাঠানোর কাজও করে যাতে পশ্চিম পাকিস্তান একেবারে অরক্ষিত না হয়ে যায় [১,৩]। এই সময় কিসিঞ্জারের সাথে বেশ কিছু কথোকথনে দেখা যায় ওরা মেনে নিয়েছে বাংলাদেশের পতন হয়ে গেছে। কিন্তু পাকিস্থানের (তারা আর পশ্চিম কথাটা ব্যবহার করে নাই) অখন্ডতা রক্ষা করাই তাদের লক্ষ্য এবং সেই অনুযায়ী কাজ করছে [১]।
এর সত্যতা পাওয়া যায় ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পনের এবং যুদ্ধ বন্ধের পর কিসিঞ্জার নিক্সনকে অভিনন্দন করে ঠিক এই ভাবে “অভিনন্দন প্রেসিডেন্ট, আপনি পশ্চিম পাকিস্তান রক্ষা করতে পেরেছেন।“ পরে নিক্সন ও বলে যে এই ব্যাপারে সোভিয়েত ইউনিয়ন গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছে [২]।অনেক কথা আছে, যার সব আসলে অল্প জায়গাতে বলা সম্ভবও না। কিন্তু বাস্তবে আমরা যা জেনে এসেছি তা আসলে পুরোপুরি সত্য না। বরং সত্য আসলে অন্য রকম। কারন আমেরিকা যদি সত্যি সত্যি যুক্ত থাকতো – এই যুদ্ধ হয়তো এত সহজে শেষ হতো না। যা ইতিহাস ঘাটলেই বোঝা যায়।
তথ্যসুত্রঃ
১) মিথ এন্ড ফ্যাক্টস , বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার – বি জেড খাসরু।
২) মার্কিন ডকুমেন্টে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ৭১- পিনাকী ভট্টাচার্য।
৩) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন ভুমিকার গোপন দলিল- আসিফ রশীদ।