আগে যখন শক্তিশালী বিরোধী দল ছিল, যেকোনো বাজেটের পরই শুনতে হতো ‘মানুষ মারা’ বাজেট। তখন বিভিন্ন যুক্তিতর্কের মাধ্যমে বাজেটে গণবিরোধী কিছু থাকলে বদলও হতো। এখনকার তথাকথিত বিরোধী দল সমালোচনা না করে বরং স্তুতিবাক্যের মধ্যেই চলে। এদিকে ব্যবসায়ীরা তাঁদের সুবিধা দাবি এবং ক্ষমতার কাছে থাকলে সেই সুবিধাগুলো আদায় করে নেন।
এ ক্ষেত্রে সংবাদপত্র যদি কিছুটা বলার চেষ্টা করে, সেটাই একমাত্র ভরসা। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলি, গত বাজেটের আগে এবং পরে এই অধম সব মিলিয়ে চারটা লেখা দিলেও সরকার কোনো কর্ণপাত না করেই নিজেদের মতো বাজেট পাস করিয়ে নিয়েছে। কিন্তু আমাদের তো চেষ্টা করতে হবে।
নিজেদের ভুলেই দেশ এক অর্থনৈতিক দুর্দশায় পড়েছে। সমস্যার আসল কারণগুলো সমাধানের চেষ্টা না করে বিভিন্নভাবে আয় বাড়ানোর চেষ্টা করছে। তাতে দেশ অন্তত শেষ সীমাতে যাওয়া আটকে দিলেও সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে এবং দেশ নিশ্চলতা-স্ফীতিতে পড়েছে। দেশের বেসরকারি খাতের ব্যবসাও হয়ে গেছে স্থবির। শুধু অলিগার্কি এবং যাঁদের অবৈধ আয় আছে, তাঁরা ছাড়া আসলে কেউই ভালো নেই। এ অবস্থায় পত্রিকার মাধ্যমে বাজেট নিয়ে যেসব খবর আসছে তা বেশ ভয়ংকর। এগুলোর বেশ কিছু পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে।
আয়করের সীমা পুনর্নির্ধারণ
আইএমএফ আমাদের আয়করের সীমা বাড়িয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা থেকে পাঁচ লাখ করতে বলেছে। ৫ শতাংশ ট্যাক্সের নিম্ন সীমা বাতিল করে ১০ শতাংশ করতে বলেছে। (ডেইলি স্টার, ১৫ মার্চ ২০২৪) আপাতত দেখতে খুব ভালো হলেও আইএমএফ যেসব খাতে কর রেয়াত এবং আয়করমুক্ত ভাতা পাওয়া যেত তা তুলে দিতে বলেছে।
এই অর্থবছরে সরকারি চাকরিজীবীদের বেশির ভাগ ভাতায় আয়করমুক্ত থাকলেও বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য তা ছিল ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া বিভিন্ন বিনিয়োগে কর রেয়াত ছিল। কিন্তু এসব সুবিধা উঠিয়ে দিলে সাধারণ মানুষের ওপর বিশাল চাপ বাড়বে।
তাই সরকারের কাছে অনুরোধ, করের নিম্ন হার বাড়ালেও সঙ্গে নিম্ন সীমা ৫ লাখ এবং আগের ভাতা এবং রেয়াত–সুবিধা বজায় রাখে। এ ছাড়াও সরকারি চাকরিজীবীদের যে দ্বৈত আইন করে সব ভাতাতে করমুক্ত সুবিধা দেওয়া হতো, তা বাতিল করেন অথবা বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্যও একই সুবিধা দেওয়া হোক। এক দেশে দুই আইন থাকতে পারে না। এ ছাড়া অতিধনী তৈরিতে দেশ বিশ্বের প্রথম সারিতে।
তাই আগের ৩০ শতাংশের যে ট্যাক্সের ভাগ ছিল তা ফিরিয়ে নিয়ে আসা উচিত। যদি তিনটি কাজ—দ্বৈত আইন বাতিল করা হয়, ২৫ শতাংশ ট্যাক্স স্ল্যাবের ৩০ লাখ টাকার পর অবশিষ্ট ব্যক্তিদের ৩০ শতাংশ ট্যাক্সের আওতায় আনলে এবং যাঁরা ট্যাক্স দেন না, তাঁদের ট্যাক্সের আওতায় আনতে পারলে সরকার মধ্যবিত্তের ওপর চাপ না বাড়িয়েও লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারবে।
পরিশেষে আইএমএফের সবচেয়ে ভালো উপদেশ, বাজেট ছোট করেন। বিশাল বাজেট বানিয়ে ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত ঠিক করতে গিয়ে আমাদের ওপর পর্বত তুলে না দিয়ে ছোট বাজেট ও ছোট বোঝা বেশি দরকার। ঋণ করে ঘি না খেয়ে নিজেদের টাকায় একটু বাঁচার চেষ্টা করি।
ভর্তুকি কমিয়ে ফেলা
আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকির অঙ্ক ১ লাখ কোটি টাকার নিচে নামিয়ে আনতে চায় সরকার। এ লক্ষ্যে আবারও বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়ানোর চিন্তাভাবনা চলছে। (আমাদের অর্থনীতি, ২৫ এপ্রিল ২০২৪)। বিদ্যুতের ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে বলা হয়েছে, বছরে চারবার বাড়বে। আবার ক্যাপাসিটি চার্জের (যা বিদ্যুৎ খাতের মোট ভর্তুকির ৮১ শতাংশ) টাকাও আমাদের ট্যাক্সের টাকাতে দেওয়া হবে, এটা কেমন বিচার! আবার ২৭ হাজার ১৬২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা থাকার পরও কেন আমাদের লোডশেডিং হচ্ছে অথবা বাইরে থেকে বিদ্যুৎ আনা হচ্ছে, সেই প্রশ্ন সবার মনে।
ট্যাক্স-ভ্যাটের চাপ
চলতি অর্থবছরে ভ্যাট ছিল মোট রাজস্বের ৩৮ শতাংশ। যা এই অর্থবছরে হতে পারে মোট রাজস্বের ৫০ শতাংশের ওপরে। (বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ৭ এপ্রিল ২০২৪) আইএমএফ আবার সব ভ্যাট ১৫ শতাংশ করে দিতে বলছে। ভ্যাট সব সময় নিম্নে যে থাকে মানে সাধারণ মানুষের ওপরে পড়ে। এই মূল্যস্ফীতির যুগে যা আরও বোঝা হয়ে যাবে। ভ্যাট ফ্ল্যাট রেট করা ভালো, কিন্তু ১৫ শতাংশ অনেক বেশি। তবে ভ্যাটমুক্ত ক্ষেত্রগুলোতে ভ্যাট আরোপ করে আওতা বাড়ানো সম্ভব।
তদ্রূপ ট্যাক্সের আয় বাড়াতে সরকার অগ্রিম আয়করের দিকে বেশি নজর দিতে চাচ্ছে। এর ফলে যারা ট্যাক্স দেন, তাঁদের ওপর চাপ পড়বে। সরকার অনেক দিন ধরে আয়কর প্রদানকারীদের সীমা বাড়াতে চাচ্ছে, কিন্তু বলার মতো সফলতা নেই। কেন? এই দায় কেন যাঁরা দেন, তাঁদের বহন করতে হবে?
টেকসই উন্নয়ন খাতে ব্যয় বৃদ্ধি
আমাদের দেশের উন্নয়নের জন্য প্রথমেই শিক্ষা খাতে ব্যয় বাড়াতে হবে। অন্যান্য উন্নয়ন বাদ দিয়ে হলেও শিক্ষা খাতে জিডিপির ৬ শতাংশ, পরিবেশ খাতে কমপক্ষে ৩.২ শতাংশ এবং সামাজিক নিরাপত্তা খাতে পেনশন বাদে ৪ শতাংশ করতে হবে। এই খাতগুলোতে সরকার বিনিয়োগ না করলে আমরা দিন দিন পিছিয়ে যাব। এই দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লে ভ্যাট, ট্রেনিং করলে ভ্যাট। উন্নয়নটা বড়লোকদের হয়ে যাচ্ছে।
অপচয় এবং খরচ কমান
সরকারের তিনটা প্রধান খাত তার কর্মচারীদের বেতন-ভাতা এবং পেনশন দেওয়া ও মেগা প্রকল্প। বেতন–ভাতার ক্ষেত্রে খুব বেশি কিছু করার নেই। কিন্তু তাদের কি পেনশন স্কিমে নিয়ে আসা সম্ভব? তাহলে নিজেদের অনেক খরচ কমত। আর এই অসময়ে অপ্রয়োজনীয় মেগা প্রকল্প এবং বিদেশ থেকে অপ্রয়োজনীয় আমদানি, বিদেশ সফর, কথায় কথায় গাড়ি কেনা ও অতিরিক্ত ব্যাংকঋণ নেওয়া বন্ধ করতে হবে।
মূল্যস্ফীতি ও নিশ্চলতা স্ফীতি কমান
এ দুটি বিষয় কমানোর সরকারের কোনো বিকল্প নেই। বাজেটে অবশ্যই কমানোর দিকনির্দেশনা এবং ব্যবস্থা থাকতে হবে। বেসরকারি খাতের জন্য ব্যবসা যাতে গতি পায়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। দেশকে আত্মনির্ভর করার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। যেখানে আমাদের ডলারের সংকট, সেখানে কেন আমরা দেশকে আমদানিনির্ভর রাখব?
এখন অনেক কিছু পত্রিকায় আসে না। কিন্তু আমাদেরও জানার দরকার আছে সঠিক মূল্যস্ফীতি কত? আমাদের যে পাহাড়সম ঋণ সরকারি ও বেসরকারি খাতে, তা কমানোর জন্য কি পরিকল্পনা আছে? পাচার করা অর্থ কি ফিরিয়ে নিয়ে আসার কিছু অগ্রগতি হয়েছে? যেখানে শেয়ারবাজারে সুযোগ বৃদ্ধি করার কথা, সেখানে ক্যাপিটাল গেইনের ওপর ট্যাক্স দিয়ে লাভ আরও কমিয়ে নেওয়া হচ্ছে, এটা কেন? এ ছাড়া প্রচুর দ্বৈত আইনের সুযোগে সাধারণ মানুষ নিষ্পেষিত হচ্ছে। আসলে সব পয়েন্ট ধরে একটা করে কলাম লেখা যায়। সাহায্য তাদের করা যায়, যারা শোনে।
পরিশেষে আইএমএফের সবচেয়ে ভালো উপদেশ, বাজেট ছোট করেন। বিশাল বাজেট বানিয়ে ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত ঠিক করতে গিয়ে আমাদের ওপর পর্বত তুলে না দিয়ে ছোট বাজেট ও ছোট বোঝা বেশি দরকার। ঋণ করে ঘি না খেয়ে নিজেদের টাকায় একটু বাঁচার চেষ্টা করি।