অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা

আমাদের দেশে একটা কথা আছে। ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা ওষুধ দেবো, কোথা?’ এখন সব ব্যথা নিয়ে আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিলো। এখন তাদের কাছে আমাদের এত এত বেশি চাওয়া, এবং ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার যেভাবে সব নষ্ট করে গেছে- তা আসলে পিঁপড়ার কাছে পর্বত আহরণের মতোই কঠিন কাজ। এই কাজ করতে গেলে সিস্টেমের ভেতরে থাকা ব্যুরোক্রেটিক মানুষজনই বাধা  দেবে। 

এখন বলে নেই- এই সরকারের উপদেষ্টার ইচ্ছা নিয়ে কারও কোনো সন্দেহ নাই। আমাদের এই ক্রান্তিকালে ড. ইউনূসের মতো ভরসা করার আসলেই কেউ নাই। আমাদের বিদেশের চাপ সামলানো উনি করতে পারবেন, অর্থনীতি দাঁড় করানোর মতো উনার থেকে বড় ভরসার জায়গাও নাই। রাষ্ট্র বিজ্ঞানের সংজ্ঞা মতে এটা যেহেতু টেকনোক্রেটিক সরকার- তাই তাদের যদি পরবর্তীতে উপদেষ্টা বৃদ্ধি করতে হয় তাহলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মতো বিশেষায়িত মন্ত্রণালয়ের জন্য প্রকৌশলী; কৃষি মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব একজন কৃষিবিদকে; একজন বেসরকারি খাতের একজনকে দরকার; কারণ ৯৫ শতাংশ চাকরি আসে বেসরকারি খাত থেকে যা এখন স্থবির এবং সরকারের এডমিনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষ যুক্ত করলে উনার কাজ আরও সহজ হবে। নইলে আমাদের ব্যুরোক্রেটদের কাছে পদে পদে তাদের বানানো সিস্টেমেই ভুগতে হবে। 

এখন উনার কাছে আমাদের প্রত্যাশা কি কি? এক একটা সংস্কারের কথা বলতে গেলে আসলে বই হয়ে যাবে। এই লেখাতে আমি চাওয়াগুলো সংক্ষেপিত আকারে প্রকাশ করছি: 

গণহত্যার বিচার এবং সঠিক তথ্য উপাত্ত সংরক্ষণ: জুলাই থেকে যতগুলো হত্যা হয়েছে সব হত্যার বিচার করতে হবে। যারা পলাতক তাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে, এবং আনতে না পারলে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার করতে হবে। ফ্যাসিস্ট সরকার আয়নাঘর এবং ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলি করে সব রকম আইন ভেঙে ফেলেছে। ফ্যাসিস্ট দল সব দেশে সব সময় নিষিদ্ধ হয়। আমাদের দেশেও তা করা উচিত। এ ছাড়াও যারা যারা মারা গেছেন বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই আন্দোলনের ফলে তাদের সবার নাম-ঠিকানা পরিষ্কার লিপিবদ্ধ করতে হবে। আমরা ১৯৭১ সালের মতো ভুল আর একবার হোক তা চাই না। এই শহীদদের আলাদা আলাদা করে ক্ষতিপূরণ এবং রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দিতে হবে। 

নতুন সংবিধান: বাংলাদেশের যত সমস্যার মূলে সংবিধান। এই সংবিধান স্বৈরাচার হওয়ার সুযোগ দেয় এবং মানুষ এখানে প্রজা। অনেকেই বলছে- এই সরকারের সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা নাই। কেন? বিপ্লব/স্বাধীনতা বা ফ্যাসিজম পতনের পর কোন দেশ আবার আগের সংবিধানে চলেছে? নতুন সংবিধান দেশের প্রায় সব মানুষই চায়। 

শিক্ষা খাত: আমাদের শিক্ষা খাত নতুন ভাবে ঠিক করতে হবে। আগের সিলেবাস বাদ দিয়ে নতুন সিলেবাস বানানো লাগবে। যদি নিজেদের সেই যোগ্যতা না থাকে অক্সফোর্ডের সিলেবাসের বইগুলো বাংলা করে ছাত্রদের দিয়ে দিতে পারেন। নকল বন্ধ করতে হবে, গণ এ প্লাস বন্ধ করতে হবে এবং প্রশ্নফাঁস বন্ধ করতে হবে। ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গবেষণামুখী করতে হবে এবং সিলেবাস আপডেট করতে হবে। 

অর্থনীতি: দেশের অর্থনীতির অবস্থা এখন এক কথায় খুবই খারাপ। মূল্যস্ফীতির জন্য মানুষজনের নাভিশ্বাস উঠছে, অবশ্যই এই সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। দেশের রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে, সেই জন্য অবশ্যই হুন্ডি বন্ধ করতে হবে। বিদেশে আটকে থাকা এক্সপোর্টের টাকা নিয়ে আসতে হবে, পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে হবে, ব্যাংকের লোন ফেরত আনতে হবে অনেক অনেক কাজ। আর্থিক খাতে আইএমএফের সংস্কার এখনো বোঝা যাচ্ছে না। এদিকে ব্রুগেলের জুন সংখ্যাতে রিয়েল এফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট ছিল ডলারের ১৫৩.২ টাকা। এখন কতোক্ষণ ডলার রেট কমিয়ে রাখতে পারবে সেটাও দেখার বিষয়। ক্যাপাসিটি চার্জ, ভারতকে দেয়া অন্যান্য অবৈধ সুযোগ বন্ধ করলে বেশ কিছু ডলার রক্ষা করা সম্ভব। 

চিকিৎসা খাত: ইচ্ছাকৃত ভাবে আমাদের চিকিৎসা খাতকে বিদেশমুখী করে রাখা হচ্ছে; যাতে ভারতে গিয়ে মানুষ অর্থ খরচ করে আসে। এই অবস্থা আমাদের নিজেদেরই ঠিক করতে হবে। কারও যেন বিদেশে গিয়ে আর চিকিৎসা নিতে না হয়; এই ভাবে পরিকল্পনা সাজানো উচিত। শ্রদ্ধেয় জাফরুল্লাহ স্যারকে খুব মিস করছি। উনার স্বপ্ন কি আমরা বাস্তবায়ন করতে পারবো না?

বিচার বিভাগ স্বাধীন এবং যোগ্যকরণ: আমাদের বিচার বিভাগ স্বাধীন এবং তাদের যোগ্য করতে হবে। আগের দলীয় বিবেচনার সব নিয়োগ বাতিল করতে হবে। বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রে ন্যূনতম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স এবং প্রথম শ্রেণি থাকতে হবে। কেউ যেন বিচারের কাঠগড়াতে গিয়ে অমুকের লোক বলে সুবিধা না পেয়ে, বাংলাদেশের লোক হিসেবে বুক ফুলিয়ে চলতে পারে- সেই ব্যবস্থা লাগবে। 

সরকারি চাকরি ব্যবস্থা সংস্কার: আমাদের সরকারি চাকরিও যেন স্বৈরাচারের আর একটা উদাহরণ। যারা যারা সরকারি চাকরির নিয়ম ভেঙে দলীয় মুখপাত্রের কাজ করেছে- তাদের বরখাস্ত করতে হবে। এ ছাড়া সরকারি চাকরিতে নাই চাকরি হারানোর ভয়। ফলে তারা যা খুশি তা করতে পারে। এটা বন্ধ করে সরকারি চাকরি ভারতের মতো কন্ট্রাকচুয়াল করে পদোন্নতি এবং রিনিউয়াল পারফর্মেন্সের উপর করতে হবে। যোগ্য লোককে তার উপযুক্ত ডিপার্টমেন্টে দিতে হবে। সব সরকারি অফিসে বাৎসরিক অডিট হতে হবে এবং সবার ট্যাক্স ফাইল এবং সম্পত্তির হিসাব নিয়মিত দিতে হবে এবং তা অন্য কারও মাধ্যমে ভ্যারিফাই করতে হবে। সোজা হিসেবে তাদের কাজ করতে হবে এবং দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। 

বেকারত্ব নিরসন: সরকারি চাকরির যত নিয়োগ বাকি আছে তা সম্পন্নকরণ। প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে অবৈধ ভাবে যে সব ছাত্রলীগ চাকরিতে ঢুকে গেছে, তাদের বহিষ্কার করতে হবে। পুরো চাকরির সংস্কার করতে হবে।  বেসরকারি খাত উন্মুক্ত করতে হবে। অবৈধ বিদেশি বিতাড়ন করা লাগবে। আমাদের যে করেই হোক স্ট্যাগফ্লেশন বা নিশ্চলতাস্ফীতি দূর করতে হবে। 

ব্যবসা সহজীকরণ: আগেই বলেছি বেসরকারি খাত স্থবির। আমাদের দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে হবে, হতে হবে দেশীয় ভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ব্যবসা যেকোনো উপায়ে সহজ করতে হবে। এই দেশে ব্যবসার প্রসেসের জন্যই অনেক কর্মঘণ্টা নষ্ট হয় এবং হয় অতিরিক্ত খরচ। বিদেশি বিনিয়োগ আনতে হবে। 

দুর্নীতি দূরীকরণ: এই ফ্যাসিস্ট সরকার যা করেছে তা হলো পদে পদে দুর্নীতি দেশকে দিয়ে গেছে। হাজার কোটির নিচে কোনো টাকাই টাকা না। কারও হয় নাই শাস্তি। ইচ্ছামতো টাকা পাচার হয়েছে। বিচারপতি, সরকারি কর্মচারী থেকে রাজনীতিবিদ কেউ ছাড়ে নাই দেশটাকে ধ্বংস করতে। তাদের ধরে দ্রুত বিচার আদালত দিয়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। কেউ যেন ভবিষ্যতে এই সাহস না করে। 

সন্ত্রাস দূরীকরণ এবং আগের পাপের বিচার: অতিসত্বর চিরুনি অভিযানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের গুণ্ডাদের হাতে থাকা অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে। এ ছাড়া চাঁদাবাজি বা হিন্দু নির্যাতনের সঙ্গে যে বা যারা জড়িত কাউকে ছাড়া যাবে না। এই ব্যবস্থা নিতে না পারলে আসলে লীগের সঙ্গে আপনাদেরও পার্থক্য থাকবে না। এ ছাড়া বিডিআর হত্যা, হেফাজত হত্যা, আয়নাঘর সহ সকল গুম ও খুনের বিচার করতেই হবে। আমাদের সব সমস্যার শুরু আসলে বিচারহীনতার জন্য। 

নির্বাচনী ব্যবস্থা পুনর্গঠন: এটা সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের অবশ্যই গণতন্ত্রে আসতে হবে। আমাদের ভোটের অধিকার ফিরে পেতে হবে, সেই ভাবেই আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকেও গণতন্ত্র আনতে হবে। আনতে হবে আর্থিক স্বচ্ছতা।

পররাষ্ট্রনীতি পুনর্গঠন: আমাদের পররাষ্ট্রনীতি পুরোপুরি ভারতনির্ভর হয়ে গেছে। কোনো দেশের সঙ্গে কথা বলতেও ভারতের পারমিশন লাগতো। আমাদের এখন স্বাধীন এবং স্বনির্ভর পররাষ্ট্রনীতি দরকার। এ ছাড়া এই সময়ে দেশবিরোধী যত চুক্তি হয়েছে সব বাতিল এবং এর সঙ্গে যারা যারা যুক্ত ছিল তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। 

এত এত চাওয়া অল্প জায়গায় লিখে শেষ করাটা কঠিন। এই সরকারের জন্যও করা কঠিন। শুধু আশা রাখলাম প্রফেসর ড. ইউনূসের প্রতি। উনি উনার জীবনের সব চেয়ে বড় কাজটাতেও সফল হবেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top