সরকারি কর্মচারীরা কি নিজেরা নিজেদের বিপদে ফেলছেন

সরকারি কর্মচারীরা কি নিজেরা নিজেদের বিপদে ফেলছেন

বেসরকারি চাকরিজীবীদের নিয়ে লেখালেখি করতে গিয়ে মাঝেমধ্যে সরকারি কর্মচারীদের থেকেও আমাকে অনুরোধ করা হয় তাঁদের সমস্যা নিয়ে লিখতে। তাঁদের বহুদিনের দাবি নতুন পে স্কেল। বর্তমান সময়ে আসলে সৎ কর্মচারীদের জন্য চলতে পারাটাই কঠিন। কিন্তু এই কাজগুলো কি দ্বারাই কঠিন হয়নি?

এখন ২০১৫ সালের সর্বশেষ পে স্কেলের সময়ই কিন্তু বলা হয়েছিল, ভবিষ্যতে আর কোনো পে স্কেল দরকার হবে না। নিয়মতান্ত্রিকভাবে ৫ শতাংশ করে ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হচ্ছে, যা মূল্যস্ফীতিকে সমন্বয় করবে। যাঁরা প্রস্তাবনা করেছিলেন, তাঁরা কীভাবে জানলেন মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের মধ্যে থাকবে? তাহলে এখন দায়টা কার?

সরকারি কর্মচারীরা বলতে চাইছেন, জিনিসপত্রের অত্যধিক দাম। তা-ই কি? আসুন দেখে নিই সরকারি হিসাব কী বলে। ২০১৬ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর মূল্যস্ফীতি যথাক্রমে ৫ দশমিক ৫১ শতাংশ, ৫ দশমিক ৭ শতাংশ, ৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ, ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ, ৫ দশমিক ৬৯ শতাংশ, ৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ, ৭ দশমিক ৭ শতাংশ, ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ (ম্যাক্রো ট্রেন্ডস ডটকম এবং বাংলাদেশ ব্যাংক)। যার গড় করলে আসে ৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ।

এখন গত বছরে মহার্ঘ ভাতাসহ ৫ শতাংশ বৃদ্ধি ধরলে এই ৮ বছরে বেতন বেড়েছে ৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ। এখন সরকারি কর্মচারীদের যদি বেতন সমন্বয় হয়, তাহলে কত বাড়বে জানেন? মাত্র ৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ। সরকারি কর্মচারীদের তাঁদের ভাতার ওপর ট্যাক্স দেওয়া লাগে না। সে হিসেবে আসলে এই হিসাবের থেকে বেশি টাকা সমন্বয় হয়ে যায়। বেসরকারি খাতে কিন্তু বছর বছর ট্যাক্সের পরিমাণ বাড়ছেই।

আরও আছে, সারা বিশ্বে এখন সিটিসি (কস্ট টু দ্য কোম্পানি) হিসেবে বেতন-ভাতা হয়। সরকারি কর্মচারীরা পড়ে আছেন সেই ব্রিটিশ আমলের যুগেই। এ ক্ষেত্রে আধুনিকতা আনার দায়িত্ব কি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছিল না?

কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকই ভারতের বেতনের উদাহরণ দেন। তাঁদের উদ্দেশ্যে বলি, সেখানে বেতন হয় এই সিটিসির ওপর, বেসিক বেতন ধরে নয়। আর তাদের চাকরি বাংলাদেশের মতো নিশ্চিত চাকরিও নয়, পারফরম্যান্সের ওপর ভিত্তি করে; কাজ ঠিকমতো না করলে চাকরি চলেও যায়। আর এ ব্যবস্থা আনার পরই ওদের সরকারি খাত আগের তুলনায় অনেক পেশাদার হয়েছে। আজ থেকে ২৫ বছর আগেও তারা আমাদের মতোই কি ছিল না?

আর এ রকম একটি পে স্কেল যদি হয়ও তাহলে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে ৩ গুণ। এতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোনো লাভ হবে কি? সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া আসলে কার কাজ? সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরই তো। তাঁরা কি আসলে সেই কাজটি ঠিকঠাক মতো করছেন? নিশ্চয়ই অনেকেই আছেন, যারা সঠিক দায়িত্বটাই পালন করে যাচ্ছেন কিন্তু তাঁদের সংখ্যাটা গৌন বা সিস্টেমের কারণে হোক এর সুফল কি পাচ্ছি আমরা?

মূল্যস্ফীতির যে হিসাব তা আপনাদেরই করা।  এর সঙ্গে বাস্তবতার মিল আছে কি? আসল হিসাব থেকে প্রায় অর্ধেকের থেকেও কম দেখিয়ে এত দিন সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়ানো এবং ওপরের মানুষজনকে সন্তুষ্ট করে এখন কোন হিসেবে পে স্কেল পাওয়া সম্ভব? যখন দেশের সবচেয়ে বড় খরচের খাত হচ্ছে বেতন-ভাতা।

সরকারের ওপর চাপ আছে খরচ কমানোর। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ তাদের বাংলাদেশের সমস্যা নিয়ে জানুয়ারি মাসে রিপোর্টে ২০ শতাংশ বেতন-ভাতা কমানোর প্রস্তাবনা দিয়েছিল। তাদের দোষ দিয়ে আসলে লাভ নেই, যেকোনো দাতা সংস্থাই যখন কোনো রিপোর্ট লেখে, তারা সরকারি তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই লেখে। আর সেই তথ্য অনুসারে আসলে সরকারি বেতনকাঠামো দেশের সার্বিক অর্থনীতির থেকে কিন্তু খুব পিছিয়ে নেই। কিন্তু এটা কি বাস্তবতা?

দেশের পেনশন খাতে সরকারের বিশাল একটা খরচ আছে, যা কমাতে হবেই। হয়তো শিক্ষকদের মতো গেজেটেড কর্মচারীরা এখন ভাবছেন, আমাদের কী? কিন্তু নগর পুড়লে কি দেবালয় রক্ষা পাবে? দ্বৈত আইন আপনাদের আসলে কত দিন আলাদা করে রাখতে পারবে? গ্রামবাংলার কথাটা কি মনে আছে, অন্যের জন্য কুয়া খুঁড়লে একসময় নিজেদেরই পড়া লাগে। আসুন না, সব দ্বৈত আইন বাতিলসহ আমাদের সবার জন্য লাভজনক একটা স্কিম বানিয়ে ফেলুন। তাহলে জোর করা লাগবে না আর। আর বদলে ফেলার ক্ষমতা তো আপনাদের হাতেই।

সরকারি তথ্যের ওপরই বিশ্বব্যাংক আশা করছে, আগামী বছর মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম’ হিসেবে হয়তো আপনারা হিসাবও মিলিয়ে দেবেন। এ রকম তথ্যের গরমিল যত দিন থাকবে, দেশের এই বিপদ কাটানো সম্ভব নয়। ঠিক করতে হবে সব আর্থিক নির্ধারকগুলো, যার শুরু জনসংখ্যার হিসাব থেকে।

এরপর আসি সর্বজনীন পেনশন স্কিম নিয়ে। ২৮ আগস্ট ২০২৩-এ প্রথম আলো অনলাইনে আমার লেখায় (পেনশন সবার জন্য লাভজনক করার ইচ্ছা কি সরকারের আছে)  আর্থিক বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিলাম, এই স্কিম মোটেও লাভজনক নয়।

আমি আশা করেছিলাম, যেহেতু আমি একাডেমিক দিক থেকে প্রশ্ন তুলেছি, তাই অন্য একাডেমিশিয়ানরাও যুক্তিতর্কের মাধ্যমে ভুলত্রুটি সংশোধনের মাধ্যমে এই স্কিমকে কীভাবে সফল করা যায়, সেই চেষ্টা করবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, তখন কোনো ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণ ছাড়াই বরং বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দলীয় মুখপাত্রের মতো স্তুতি গেয়েছিলেন।

অনেক স্বায়ত্তশাসিত অফিসের কর্মচারীরাও আমাকে এটা নিয়ে কথা না বলতে বলেছিলেন। তাঁদের চুপ থাকার ফলে সরকার প্রভিডেন্ট ফান্ডের ওপর ট্যাক্স বসিয়েছিল, জীবনবিমার ভালো স্কিম বন্ধ করে মানুষজনকে পেনশন স্কিমে আনার চেষ্টা করেছে। যখন এটা একেবারেই ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে, তখন পুরো সরকারি বাদে বাকি সরকারি পে রোলে থাকাদের পেনশন স্কিমে আনার চেষ্টা শুরু হয়েছে। দেশ রূপান্তরে ১৪ মে ২০২৪-এ প্রকাশিত হয়েছে, ‘সর্বজনীন পেনশন মানবেনই না বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষকেরা’। প্রশ্ন হচ্ছে, এত দিন আপনারা কোথায় ছিলেন?

আসলে উপায় নেই। দেশের পেনশন খাতে সরকারের বিশাল একটা খরচ আছে, যা কমাতে হবেই। হয়তো শিক্ষকদের মতো গেজেটেড কর্মচারীরা এখন ভাবছেন, আমাদের কী? কিন্তু নগর পুড়লে কি দেবালয় রক্ষা পাবে? দ্বৈত আইন আপনাদের আসলে কত দিন আলাদা করে রাখতে পারবে?

গ্রামবাংলার কথাটা কি মনে আছে, অন্যের জন্য কুয়া খুঁড়লে একসময় নিজেদেরই পড়া লাগে। আসুন না, সব দ্বৈত আইন বাতিলসহ আমাদের সবার জন্য লাভজনক একটা স্কিম বানিয়ে ফেলুন। তাহলে জোর করা লাগবে না আর। আর বদলে ফেলার ক্ষমতা তো আপনাদের হাতেই।

এ ছাড়া সঠিক তথ্য না পাওয়ায় সরকারের পরিকল্পনার একটাও ঠিকমতো কাজ করছে না। বিদেশি দাতারা দিতে পারছে না সঠিক দিকনির্দেশনা। দেশে চলছে নিশ্চলতাস্ফীতি। আর ও আছে। ব্যাংক ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে টাকা তুলতে না পারলে তা উদ্ধারের দায়িত্ব আদালত বা বাংলাদেশ ব্যাংকের। কিন্তু নিত্যনতুন সুযোগ দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক যেন ঋণখেলাপিদের প্রণোদনা দিতেই ব্যস্ত। আদায়ের কোনো চেষ্টাই নেই।

পাচার করা টাকা ফিরিয়ে নিয়ে আসার দায়িত্ব ও সরকারি কর্মকর্তাদের। তাঁরা কি আনতে পারছেন? কীভাবেই-বা পারবেন—এক মন্ত্রীর মুখেই শুনেছিলাম যে বেগমপাড়ার বেশির ভাগ বাসিন্দা সরকারি কর্মচারী। এসব অসৎ, ক্ষমতালোভী কর্মকর্তা তাহলে কেন দেশের মানুষের কথা চিন্তা করবেন? আবার নিজেদের বিপদে যাতে পড়তে না হয়, সে জন্য বরং বিভিন্ন ইনডেমনিটি নিয়ে নিজেদের রক্ষা করবেন এবং সরকারকে খুশি রাখতে যা করা লাগে করবেন।

দেশের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানের বেশির ভাগ কাজেই সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ব্যর্থ। আর তাঁদের অনেকের এই শপথ ভাঙার মতো কার্যকলাপের শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সৎ কর্মচারীরাও। সরকারি কর্মকর্তাদের কাজ হচ্ছে নিজের কাজ ঠিকমতো করে সরকারকে সঠিক পথ দেখানো। কিন্তু তা কি সবাই করছেন, নাকি কেউ কেউ ক্ষমতার আরও কাছে যাওয়ার চেষ্টাতে আছেন?

ছোট্ট করে বলি—ব্যাংকের যে গার্ড ৮-১০ হাজার টাকা বেতন পান, তিনি কীভাবে চলছেন, একটু কি জানার চেষ্টা করছেন? তাঁর তো কোনো উপরিও নেই। এটা তো সরকারি কর্মকর্তাদেরই দায়িত্ব, তাই নয়? আপনারা সঠিকভাবে কাজ করলে এখন আর পে স্কেলের জন্য সরকারি দয়া বা আইএমএফের অনুমতির জন্য অপেক্ষা করা লাগত না। হিসাব দিয়েই নিজেদের কথা বলতে পারতেন অথবা হয়তো দেশ এ রকম খারাপ পরিস্থিতিতে যেতই না। আপনারাই তো দেশে থাকাদের মধ্যে সেরা মেধা।

দেশের সত্যিকারের উন্নয়ন তখনই বলা যাবে যে পিরামিডের সবচেয়ে নিচে যে মানুষটা আছে, সে-ও যেন সমান সুবিধা পায়। আমাদের জন্য আসলে সবই ‘দূরঅস্ত’।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top