গত বছর আমার লেখা ‘অস্বাভাবিক গরমের দায় কি সরকার এড়াতে পারবে?’ কলামে সরকারের উন্নয়নকাজ কীভাবে পরিবেশের ক্ষতি করছে তা দেখিয়েছিলাম। যা হয় এই দেশে, কেউ কিছুই ঠিক করার চেষ্টা করেনি। ফলাফল এই বছরও অস্বাভাবিক গরম এবং ভবিষ্যতে তা আরও বাড়বে। আমরা যে আমাদের নীতির জন্য পরিবেশের ক্ষতি করে ফেলেছি, তা ঠিক কি সাধারণ মানুষ করতে পারবে?
মিঠাপানি হারিয়ে যাচ্ছে
ঢাকাসহ সারা দেশে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। ঢাকায় যেখানে ১৯৯৬ সালে ২৫ মিটার নিচে পানি ছিল, তা এখন চলে আসছে ৭৫ মিটারে। আমি ঈদের সময় মেহেরপুরে গিয়েছিলাম। সেখানে অনেক পুকুর এখন শুকিয়ে চৌচির। গুগলে পানির স্তর নেমে যাওয়া নিয়ে সার্চ করলে এ রকম পানির স্তর নেমে যাওয়ার অনেক খবর পাওয়া যাবে। এটা শুধু সুপেয় পানির অভাব দেখাচ্ছে না, ভূমিকম্পের আঘাতে দেশকে আরও ভঙ্গুর করে ফেলছে। কোনো চেষ্টা কি করা হচ্ছে ঠেকানোর?
এ ছাড়া আছে গর্ত ভরাট করে আবাসিক প্রজেক্ট। একটি শহরে ১৫ শতাংশ জলাশয় থাকা উচিত। আর ঢাকায় আছে মাত্র ২ দশমিক ৯ শতাংশ। সাঁতারকুলের ওখানে একটা জলাধার আছে, তা–ও সেদিন ছবি দেখলাম বাঁশ পুঁতে পুঁতে মানুষের দখল শুরু করেছে। সারা দেশেই এ রকম জলাশয় ভরাটের উৎসব চলছে। খালগুলো সব দখল হয়ে গেছে। এই দখলদারি কারা করে? আইন কোথায়?
এরপর আসি নদীর কথায়। নদীগবেষকেরা বলছেন, ষাটের দশকে সাড়ে সাত শ নদী ছিল বাংলাদেশে। বর্তমানে এ সংখ্যা কমে মাত্র ২৩০টিতে দাঁড়িয়েছে। ৫০ বছরে হারিয়ে গেছে ৫২০টি নদী। (বাংলা ট্রিবিউন সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৬) ভারতের উজানে বাঁধ দেওয়ার কারণে আমাদের নদীগুলো হারিয়েই যাচ্ছে। বাড়ছে লবণাক্ততা। বাংলাদেশকে কি আর নদীমাতৃক দেশ বলা যাবে?
অভিন্ন নদীগুলোর প্রায় প্রতিটিতে এবং এর উপনদীগুলোতেও ভারত অসংখ্য প্রকল্প নির্মাণ করেছে, করছে। ইতিমধ্যে দেশটির ২৯ রাজ্যের ২২টিতেই নদী অববাহিকায় নির্মাণ করা হয়েছে ৪৩০০টি বাঁধ। আরও বাধ আছে পাইপলাইনে (ইন্টারন্যাশনাল রিভারস.ওআরজি)। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা (জিবিএম) অববাহিকার দেশগুলোর পরিকল্পনাধীন বাঁধের সংখ্যা ৪১৪টি। এর মধ্যে নেপালে ২৮৫টি, ভারতে ১০৮টি, ভুটানে ১২টি, চীনে ৮টি ও বাংলাদেশে ১টি। ব্রহ্মপুত্র নদের চীনা অংশ ইয়ারলুং স্যাংপো থেকে পীত নদীতে বছরে ২০ হাজার কোটি ঘনফুট পানি সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে চীনের। অন্যদিকে ন্যাশনাল রিভার লিংকিং প্রজেক্টের (এনআরএলপি) আওতায় ৯ হাজার ৬০০ কিমি খাল খননের মাধ্যমে নিজ সীমানার ৪৪টি নদীকে সংযুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে ভারতের। (দ্য হিন্দু, সেপ্টেম্বর ৪, ২০১৮)।
নদীগুলোতে মাছ নেই, স্রোত নেই, পলি জমে গেছে। সাদা চোখেই পদ্মার দিকে তাকালে বলে দেওয়া যাবে—পানি আসছে না। তিস্তা নিয়ে আমরা কি আন্তর্জাতিক ফোরামে কখনো কিছু বলেছি? আর অন্য যেসব নদী থেকে পানি নিয়ে যাচ্ছে? অবশ্য বরং আমরা নিজেরাই আগবাড়িয়ে ফেনী নদীর পানি দিয়ে দিচ্ছি। বাংলাদেশের মতো প্রতিবেশী পাওয়া আসলে যেকোনো দেশের জন্যই সৌভাগ্যের কথা।
গবেষকেরা বলছেন, এভাবে যদি চলতে থাকে ২০৪০ সালে মধ্যেই খাওয়ার পানির অভাব তীব্র হবে এবং পানি নিয়ে বিশ্বে অনেক যুদ্ধ হলেও সাম্প্রতিক সময়ে তা দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু তাঁদের ধারণা, বিশ্বে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হলে তা হবে পানি নিয়ে।
চাষের জমি কমে যাওয়া
সরকারি হিসেবে জনসংখ্যা না বাড়লেও প্রতিনিয়ত ঘরবাড়ি বানানোর জন্য চাষের জমি কমছে, গাছ কাটা হচ্ছে। প্রতিবছর আবাদি জমি কমছে ৩৮ হাজার একর করে। তাহলে ৫০ বছরে কত কমেছে? এর ফলে গাছ কি কমছে না? ভারতে আবাদি জমি সংরক্ষণ আইন আছে, আমাদের দেশে কেন করা হচ্ছে না?
বনাঞ্চল প্রভাবশালীদের দখলে
বিশ্বে বনভূমি দখলের শীর্ষে আছে বাংলাদেশ। সারা দেশে দখল করা বনভূমি ২ লাখ ৫৭ হাজার একর। (কালের কণ্ঠ, এপ্রিল ২২, ২০২৪)। কিন্তু যা হয়, কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ক্ষমতার বলয়ের কাছের মানুষজন হওয়ায় তাদের কিছুই হচ্ছে না। তারা এই দখল থেকে মূল্যবান গাছ কেটে নিচ্ছে, ভূমি দখল করছে এবং জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে।
ছাত্রলীগ পাঁচ লাখ গাছ লাগাবে বলেছে। খুবই ভালো খবর। কিন্তু তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাস্যরস তৈরি হয়েছে। কারণ তাদের গাছ লাগানোর পরিকল্পনার বিষয়টি অনেকে বিশ্বাস করতে চাইছেন না। দখলদারদের বিচার না হওয়ার কারণে মানুষের ভালো কাজেও আস্থার জায়গাটা হারিয়ে যাচ্ছে এভাবে।
উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে পরিবেশের ক্ষতি বিবেচনা না করা
দেশের অনেক জায়গায় দুই লেনের রাস্তা চার লেন হচ্ছে—আর রাস্তার পাশে যে বিশাল বিশাল গাছ ছিল, তা সুন্দরভাবে কেটে ফেলা হয়েছে। সেদিন একজন বলছিলেন, রাস্তার ধারে বাসের জন্য যে অপেক্ষা করব—কোনো ছায়া নেই। দেখা যাবে, নতুন প্রজেক্ট আসবে ছাউনি নির্মাণ। হাওরের পানি চলাচলের পথ রাস্তা দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিশ্বে যেখানে ফসিল ফুয়েল দিয়ে পাওয়ার প্ল্যান্ট করা কমে যাচ্ছে, আমরা করেই যাচ্ছি।
সুন্দরবনের নদী দিয়ে আমরা কয়লা পরিবহন করছি। উন্নয়নের জন্য আমরা গত ১৫ বছরে যে পরিবেশের ক্ষতি করেছি, তার প্রভাব কি এখন পাচ্ছি না? সারা ঢাকা শহরে এখন মাটি খুঁজে বের করতে কষ্ট হয়ে যায়, বৃষ্টির পানি নামবে কী করে? এখন গরম বলে অস্থির হচ্ছেন—বর্ষাকাল এলে তো জলাবদ্ধতা নিয়ে চিৎকার করবেন। কিন্তু সমাধান কোথায়?
পরিবেশদূষণ
আমরা বহুদিন ধরে প্রায় সব দূষণের শীর্ষ স্থান নিয়ে আছি। এই দূষণের ফলেও কি পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে না? এই দূষণ কমানোর জন্য রাস্তায় পানি দেওয়া ছাড়া (যা আসলে অপচয়) আসলে সরকার কী করছে? বরং খরচ কমানোর জন্য জ্বালানি তেলের আমদানি গ্রেড নামিয়ে দূষণ সহায়ক জ্বালানি আমদানি করা হচ্ছে না? রাস্তাঘাটে যে বাতিল বাস–ট্রাক কালো ধোঁয়া ছেড়েই যাচ্ছে, তাদের জন্য আইন প্রয়োগ কেন হয় না?
সরকার ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তার আগের বছর চেয়ে বরাদ্দ কমিয়েছে, যা জিডিপির ১ শতাংশও না। এর আগের দুই অর্থবছরেও যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, তার ৫০ শতাংশও ব্যয় করতে পারেনি অদক্ষ মন্ত্রণালয়গুলো।
এর মধ্যে এবার আশার আলো হিসেবে দেখা যাচ্ছে মানুষ গাছের ব্যাপারে সচেতন হচ্ছে। ঢাকার প্রায় সব বাসার ছাদে কিছু কিছু হলেও গাছ দেখা যাচ্ছে। অনেকেই গাছ লাগানোর জন্য চিন্তা করছেন। কিন্তু হুজুগে যদি এই গরমের মধ্যে গাছ লাগানো শুরু করলে বেশির ভাগ গাছই মরে যাবে। লাগানোর উপযুক্ত সময় বর্ষাকাল। তার আগে প্রস্তুতি নিন।
আমরা আলপনার রেকর্ড করতে পারি, এবার কি গাছ লাগানোর রেকর্ড করতে পারি না? কোন গাছ উপযুক্ত, এ ব্যাপারে আসলে বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া যায়। আর গাছ রোপণ করাই না, কীভাবে গাছ বাঁচিয়ে রাখতে হবে, সেটা নিয়েও ভাবতে হবে। ভুলে যাবেন না, গাছেরও কিন্তু জীবন আছে।
আবার আমাদের অনেক বাসার ছাদেই সোলার প্যানেল বসানো আছে। যার বেশির ভাগই নষ্ট। সেগুলা ঠিক করার ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। জলাধার ভরাট এবং কৃষিজমি নষ্ট যাতে না হয়, সে জন্য কঠোর আইন লাগবে। খালগুলা পুনরুদ্ধার করা লাগবে। আর নদী ফিরিয়ে আনার জন্য আমাদের সরকারের আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিতে হবে শক্ত ভূমিকা। মানুষ এখন প্রস্তুত সরকারকে সাহায্য করার জন্য, সরকারের উচিত উপযুক্ত গাইড দিয়ে সেই সহযোগিতা নেওয়ার।
আমরা সবাই মিলে আমাদের দেশটার পরিবেশের যে ক্ষতি করেছি, তা পূরণে এখন থেকেই কাজ করলে আরও অন্তত ১৫ বছর লাগবেই। সাধারণ মানুষ এখানে যে কাজ পারে তা হচ্ছে অপচয় রোধ করা— তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, খাবারসহ সবকিছুতেই। আসুন না সুকান্তের ভাষায় বলি, ‘চলে যাব, তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ/ প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,/ এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি/ নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’