সরকারি চাকরিজীবীদের কিছু ক্ষমতাভোগীদের জন্য যে অন্য সরকারিরা যে ভালো নেই এমন বিষয়ে একটি লেখা লিখেছিলাম প্রথম আলো পত্রিকায়। ওই লেখাটির পর অনেক মেইল পেয়েছি। কিন্তু কয়েকটা মেইলের মান দেখে আমার নিজেরও মনে হলো এসব লোকদের নিয়ে দেশ চালাতে গিয়ে সরকার নিজেও খুব স্বস্তিতে নেই।
দেশ চালানো একটা বিশাল কাজ, আর তা চালানোর জন্য দক্ষ জনশক্তি আবশ্যক। হ্যাঁ, দক্ষ জনশক্তি শুধু বেসরকারি বা বিদেশে পাঠাতেই লাগে না, দেশের সর্বস্তরে লাগে। আর এখানে যদি অযোগ্য ব্যক্তিরা বেশি হয়ে যায়, তাহলে দেশ কি ঠিকমতো চলবে? ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জানেন’, ‘প্রধানমন্ত্রী বলেছেন’—আমাদের খুব পরিচিত টার্ম। সব যদি একজনের দেখতে হয়, তাহলে অন্যদের আসলে কী কাজ?
কিন্তু এ রকম কি হওয়ার কথা ছিল? আমাদের বাবাদের সময়ে সবারই আরাধ্য ছিল সরকারি চাকরি।
পরে অনেক বিদেশি কোম্পানি বাংলাদেশে অফিস খোলাতে বেসরকারি চাকরি হয়ে যায় রমরমা। তখন আসলে অল্প বেতনে মেধাবীরা যেতে চাইতেন না। ফলে কোটা নিয়ে আসলে তখন কথাও তেমন হতো না। আমরাও ভাবতাম, যেহেতু মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরির বয়স এমনকি ছেলেমেয়েদের ও বয়স শেষ, তখন আসলে খুব বেশি ভূমিকাও ছিল না। কিন্তু গোল বাধল তিনটি ঘটনার কারণে।
১. মুক্তিযোদ্ধাদের পোষ্য কোটাতে তাঁদের নাতি-নাতনিদেরও ওই ৩০ শতাংশ কোটার অংশ করে দেওয়া।
২. দেশে নতুন করে মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট এবং সুবিধা দেওয়া শুরু হওয়াতে হুট করে অনেক নতুন মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় যুক্ত হওয়া।
৩. নিশ্চলতাস্ফীতি বা স্ট্যাগফ্লেশনের জমানাতে প্রবেশ করাতে দেশে অস্বাভাবিকভাবে বেকার বেড়ে যাওয়া।
এখন কোটাবিরোধীদের একটা বড় কথা, মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিরা আসলে এই কোটা কেন পাবেন? কোটা বাতিলের কারণ হিসেবে আইনজীবী মো. মুনসুরুল হক চৌধুরী ডেইলি স্টার-এ ১৫০ অনুচ্ছেদের কথা বলেছেন। ১৫০ অনুচ্ছেদ আসলে কী?
‘এই সংবিধানের অন্য কোনো বিধান সত্ত্বেও ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে এই সংবিধান প্রবর্তনকালে সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে বর্ণিত বিধানাবলি ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলি হিসাবে কার্যকর থাকিবে।’
স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও কি দেশ ক্রান্তিকালীন অবস্থার দোহাই দিয়ে চলবে? তাহলে এত এত উন্নয়ন কোথায় গেল? এই অস্থায়ী ধারার অজুহাত তো আর একটা ধারাকে আটকে দিচ্ছে— ‘২৯। (১) প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে।’
এই সমতা নিশ্চিত করে ২৮(১), ২৮(২) ধারাতেও। অনগ্রসরদের জন্য কিছু সুবিধার কথা বলা হয়েছে ২৮(৪) এবং ২৯(৩) ধারায়। প্রশ্ন হচ্ছে এর মধ্যে কি মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও নাতি-নাতনিরা পড়েন? তবে আমি প্রতিবন্ধী ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী কোটা সমর্থন করি এবং এটা এখনো থাকা উচিত বলে মনে করি।
এখন পর্যন্ত কি মুক্তিযোদ্ধার সঠিক তালিকা আমরা পেয়েছি? এখনো মুক্তিযোদ্ধা নন বলে বাতিল হচ্ছে অনেকের নিবন্ধন। এই তো সেদিনও আট হাজার ব্যক্তির নিবন্ধন বাতিল হলো। আবার অনেকে মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেটের জন্য তদবিরও করছেন। কোনো নিরপেক্ষ অডিট ফার্ম দিয়ে যত দিন পর্যন্ত নিরীক্ষণ না হয়, তত দিন পর্যন্ত প্রশ্ন থাকবেই। যেকোনো পড়ালেখার সার্টিফিকেটের চেয়েও এখন এই সার্টিফিকেটের মূল্য অনেক বেশি। কোটা বহাল হওয়ার ফলে তদবির আরও বাড়বে বলে মনে হয়, আসবে রাজনৈতিক চাপ।
কোটা চলে যাওয়ায় অনেক মেধাবী সরকারি চাকরিতে ঢুকছিলেন। তাঁদের স্মার্টনেস দেখে মনে হচ্ছিল হয়তো এই সিস্টেম একসময় বদলাবেই। কিন্তু আবারও সেই আগের গণ্ডিতে ঢুকে গেল বাংলাদেশ। কিন্তু এই দুই আন্দোলনের ফল বাতিল হওয়াতে শিক্ষা বন্দী হলো আরও টাকার খেলাতে এবং আপনি জানবেন না এই দেশে শিক্ষা শেষে আপনি কী করবেন। এখন সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা দক্ষতা চায়, নাকি সেই আগের সিস্টেমেই থাকতে চায়।
কোটা বাতিল হওয়ার পর দেশের তরুণসমাজের মধ্যে বিসিএস সিনড্রোম ঢুকে যায়। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাগারে শুধু বিসিএসের পড়া। আর কিছু নেই। দেশের সব মেধা শুধু একমুখী।
এই সর্বনাশা অবস্থা নিয়ে লিখে সচেতন করার চেষ্টা করলেও আসলে শুনতে হয়েছে, ‘পারলে বিসিএস দিয়ে দেখান’-এর মতো মহামূল্যবান উপদেশ। দেশে গণহারে ‘এ প্লাস’ দিয়ে সবাইকে উচ্চশিক্ষায় নিয়ে আসার ফলাফল এখন আমরা পাচ্ছি। আমাদের দেশ বেশ কিছুদিন ধরেই নিশ্চলতাস্ফীতিতে চলছে, যা এই অধম অনেক দিন ধরেই সচেতন করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিছুদিন ধরে সংবাদমাধ্যমে এলেও সরকার এখনো সম্ভবত এ ব্যাপারে সচেতন নয়।
এত এত উচ্চশিক্ষিত কিন্তু সেই অনুপাতে নেই চাকরি। দেশের বেসরকারি খাত স্থবির হয়ে যাওয়ায় তারা এই চাকরির বাজারে যথোপযুক্ত সাহায্য করতে পারছে না। আবার তরুণদের নিশ্চিত জীবন, ভবিষ্যৎ ক্ষমতার মোহ ও কারও কারও ‘আলাদিনের চেরাগ’ পাওয়ার ইচ্ছা এবং নিজেদের সব ফলকে এক ঝুড়িতে রাখার প্রবণতা কি এখন তাদের এক অনিশ্চিত জীবনের দিকে নিয়ে যাবে না?
এখন অদক্ষ সরকারি চাকরিজীবী হলে কী কী সমস্যা হয়? যেকোনো বিদেশি দর-কষাকষিতে আমাদের দেশ প্রবলভাবে হেরে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। দেশের জ্বালানি খাতকে পরমুখাপেক্ষী করে দেশের মানুষের ওপর ভর্তুকির বিশাল চাপ নিয়ে আসাও কি অদক্ষতা নয়? বাজেটের ভেতরেও সঠিক তথ্য না দিয়ে পালহীন নৌকার মতো ছেড়ে দেওয়াও কি তাদের কাজ নয়? অথবা রিজার্ভের এ রকম চাপ কেন এল?
এ রকম অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। অনেক সরকারি কর্মচারী তাঁদের কাজের দক্ষতা বৃদ্ধির চেয়ে ক্ষমতার সঙ্গে থাকাকেই সফলতা ভাবেন। তাঁদের আর এই অদক্ষতা পুরো দেশকেই বিপদে ফেলছে।
হওয়া উচিত ছিল, যে সরকারই থাকুক, তাঁদের কাজ করা উচিত দেশের ও দেশের মানুষের জন্য। কিন্তু করছেন তাঁরা সরকারের চাওয়া-পাওয়া পূরণের কাজ; যা আসলে তাঁদের শপথের বরখেলাপ। ৫২ বছরে আমরা প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীন ও স্বনির্ভর করতে পারিনি। এটা হয়েছে দেশের রাজনীতির অতি ক্ষমতা লোভের কারণেই। বিশ্বাস না হলে সত্তরের দশকে স্বাধীনতা পাওয়া অন্য দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক তুলনা করলেই বোঝা যাবে।
এই সরকারের আমলে দুটি আন্দোলন সফল হয়েছিল—কোটা আন্দোলন ও ভ্যাট আন্দোলন। এই দুটিই গত এক বছরের মধ্যে আগের অবস্থানে চলে গেলে। যেহেতু এই রায়ের ওপর আবার আপিল করা হয়েছে তাই আশা করি মহামান্য আদালত সব বিবেচনায় নিয়ে যথোপযুক্ত সমাধান দেবেন।
কোটা পুরো বাতিলও সমাধান নয়, আবার ৫৫ শতাংশ কোটা থেকে আসবে—সেটা যেকোনো বিচারেই অগ্রহণযোগ্য। এখন যত দিন আপিল চলবে, তত দিন এই কোটা বলবৎ থাকবে। তাই অন্ধভাবে সরকারি চাকরির প্রস্তুতি না নিয়ে, প্রস্তুতি নিন প্ল্যান বি ও সি এর জন্যও।
যত কিছুই হোক, কোটা চলে যাওয়ায় অনেক মেধাবী সরকারি চাকরিতে ঢুকছিলেন। তাঁদের স্মার্টনেস দেখে মনে হচ্ছিল হয়তো এই সিস্টেম একসময় বদলাবেই। কিন্তু আবারও সেই আগের গণ্ডিতে ঢুকে গেল বাংলাদেশ।
কিন্তু এই দুই আন্দোলনের ফল বাতিল হওয়াতে শিক্ষা বন্দী হলো আরও টাকার খেলাতে এবং আপনি জানবেন না এই দেশে শিক্ষা শেষে আপনি কী করবেন। এখন সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা দক্ষতা চায়, নাকি সেই আগের সিস্টেমেই থাকতে চায়।
বিশ্বে তো ২১০টির বেশি দেশ আছে। একটা দেশেও কি তাদের মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিদের জন্য চাকরির কোটা আছে? অতিরিক্ত দুই বছর সরকারি চাকরিতে ছাড় তাদের জন্য কি যথেষ্ট নয়? এত এত অনিশ্চয়তার মধ্যে বিদেশে যেতে চান ৪২ শতাংশ তরুণ। এটা কি স্বাধীনতার ৫২ বছর পর লজ্জা দেয় না?