পানি নিয়ে আমাদের দুটি সমস্যা। প্রথমত, গরমকালে আমরা পানি একেবারেই পাচ্ছি না। আবার বর্ষায় অতিরিক্ত পানি আমাদের বন্যায় ভাসিয়ে দিচ্ছে।
এটা ঠিক, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের সব থেকে বেশি ভুক্তভোগী আমরা। সঙ্গে আছে পাশের দেশ ভারতের নজিরবিহীন অসহযোগিতা। আর আমাদের নিজেদের গাফিলতি তো আছেই।
এভাবে যদি দেশ চলতে থাকে, তাহলে বন্যা বা খরার কারণে দাঁড়াতেই পারবে না।
আমাদের এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে প্রতিবছর গড়ে খরায় ক্ষতি ২ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা (কালের কণ্ঠ, ১৬ নভেম্বর ২০২২) এবং বন্যায় গড়ে প্রতিবছর ক্ষতি হয় ৩০ হাজার কোটি টাকা (জাগো নিউজ২৪, ২৮ জুন ২০২২)।
প্রাণহানির কথা তো বাদই দিলাম। আর এসব ক্ষতিতে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে ভারতের অভিন্ন ৫৪ নদীর ৫৩টিতেই দেওয়া বাঁধ অনেক বেশি ভূমিকা রাখছে। নদী গবেষকেরা বলছেন, ষাটের দশকে সাড়ে ৭০০ নদী ছিল বাংলাদেশে। বর্তমানে এ সংখ্যা কমে মাত্র ২৩০–এ দাঁড়িয়েছে।
গত ৫০ বছরে হারিয়ে গেছে ৫২০টি নদী (বাংলা ট্রিবিউন, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬)। ভারতের উজানে বাঁধ দেওয়ার জন্য আমাদের নদীগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। বাড়ছে লবণাক্ততা।
ইতিমধ্যে দেশটির ২৯ রাজ্যের ২২টিতেই নদী অববাহিকায় নির্মাণ করা হয়েছে ৪ হাজার ৩০০টি বাঁধ। আরও অনেকগুলো বাঁধ পাইপলাইনে আছে (ইন্টারন্যাশনাল রিভারস. ওআরজি)। জিবিএম অববাহিকার দেশগুলোর পরিকল্পনাধীন বাঁধের সংখ্যা ৪১৪।
এর মধ্যে নেপালে ২৮৫টি, ভারতে ১০৮, ভুটানে ১২, চীনে ৮ ও বাংলাদেশে একটি (বণিক বার্তা, ২৯ এপ্রিল ২০২৩)।
ব্রহ্মপুত্র নদের চীনা অংশ ইয়ারলুং স্যাংপো থেকে পীত নদীতে বছরে ২০ হাজার কোটি ঘনফুট পানি সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে চীনের।
অন্যদিকে ন্যাশনাল রিভার লিংকিং প্রজেক্টের (এনআরএলপি) আওতায় ৯ হাজার ৬০০ কিলোমিটার খাল খননের মাধ্যমে নিজ সীমানার ৪৪টি নদীকে সংযুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে ভারতের (দ্য হিন্দু, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮)।
এই সমস্যার সমাধান কীভাবে সম্ভব? আমরা যা করতে পারি, সেটা তিন ভাগে ভাগ করতে পারি—আন্তর্জাতিক, প্রযুক্তি ও সক্ষমতা বৃদ্ধি।
নদী নিয়ে আন্তর্জাতিক আইন বাস্তবায়ন
আন্তর্জাতিক নদীর ব্যবহার সম্পর্কে ১৮১৫ সালের ভিয়েনা সম্মেলন, ১৯২১ সালে দারিপুর নদী কমিশন কর্তৃক প্রণীত আইন, আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহারসংক্রান্ত ১৯৬৬ সালে আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫ নম্বর অনুচ্ছেদ, ১৯৭৩ সালে সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব যার অধীন কোনো রাষ্ট্র এমন কিছু করবে না, যা তার এখতিয়ারের বাইরের কোনো অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে।
১৯৭২ সালে স্টকহোমে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ মানব পরিবেশসংক্রান্ত সম্মেলন কর্তৃক গৃহীত নীতিমালা, যেখানে বলা হয়েছে যে এক দেশের কার্যক্রম অন্য দেশের পরিবেশ বিপন্ন করতে পারবে না; ১৯৯২ সালের ডারলিন নীতিমালার ২ নম্বর নীতি, প্রতিটি ক্ষেত্রে ভাটির দেশের স্বার্থ রক্ষিত হয়েছে।
১৯৯৭ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত আন্তর্জাতিক জলপ্রবাহ-সংক্রান্ত কনভেনশন যা এখন আইন।
শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও, বাংলাদেশ এখনো এই জাতিসংঘের কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি। তবে অবিলম্বে করতে হবে। কারণ, ভারত আমাদের সঙ্গে অনেকগুলো আন্তর্জাতিক আইন ভেঙেছে। তারা অনুমতি ছাড়া বাঁধ দিয়েছে, আমাদের ন্যায্য পানির হিস্যা দিচ্ছে না, তারা এই বাঁধের কারণে যে আয় করছে, তার ভাগও আইনমতো আমরা পাই।
এ ছাড়া তারা নোটিশ ছাড়া পানি ছেড়ে দেওয়া, এ কারণে যে ক্ষতিপূরণ ও পরিবেশ নষ্ট হওয়ার দায়ও এই আইনে আছে। আমরা যদি ন্যায্য হিস্যা না পাই, আন্তর্জাতিক আদালতে এসব বিচারের দাবি করতেই পারি।
যৌথ নদী কমিশনের দায়িত্বপালন
সেই ’৭২ সালে প্রতিষ্ঠা হলেও যৌথ নদী কমিশন আসলে ব্যর্থ। এখন পর্যন্ত তারা শুধু গঙ্গা চুক্তি করলেও সেখানে নেই গ্যারান্টি ক্লজ। এ কারণে কম পানি দিলেও ভারতকে ধরা যাচ্ছে না। তাদের দিকে অভিযোগ, পানি কম থাকলেও কাগজে–কলমে বেশি দেখানো হয়।
এখন যে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি দেওয়ার কথা, সেটা কতটুকু বোঝানোর জন্য শুধু বলি আমাদের কাপ্তাই বিদ্যুৎকেন্দ্র যদি পুরা শক্তিতে চলে তাহলেও ৩০ হাজার কিউসেক পানি লাগে, যার সক্ষমতা মাত্র ২৩০ মেগাওয়াট।
তাই বিশেষজ্ঞ দিয়ে এই কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে এবং অবশ্যই এর মধ্যে একজন প্রকৌশলী থাকতে হবে, যিনি বাঁধের কারিগরি বিষয় বুঝতে পারবেন। সিন্ধু নদীতে পাকিস্তান–ভারতের মধ্যে যে চুক্তি, তা ৬৫ বছরেও ঠিকমতো পালন হচ্ছে; হচ্ছে না শুধু আমাদেরই।
প্রকৌশলগত সক্ষমতা
দেশের নদীর সমস্যার জন্য দুটি প্রজেক্ট পুরোই প্রস্তুত। আর একটার দরকার উদ্ধার করা। আমাদের সব মেগা প্রজেক্ট বাদ দিয়ে এখন এসব প্রকল্প করতে হবে:
১. গঙ্গা ব্যারাজ: ১৯৮০ সালে উদ্বোধন করা প্রজেক্টটি ভারতের বাধার মুখে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ বাতিল করে। এই প্রজেক্টের সাইট নির্ধারণ করা হয়েছিল রাজবাড়ীর হাবাসপুর ও অন্য প্রান্ত সুজাপুরের লালখান।
৪ বিলিয়ন ডলারের এই প্রজেক্ট বাস্তবায়ন হলে প্রস্তাবিত গঙ্গা ব্যারাজের মাধ্যমে ১৬৫ কিলোমিটার লম্বা একটি জলাধার তৈরি করা হওয়ার কথা, যেখানে ২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি ধরবে। এটি তৈরি করতে সাত বছর লাগবে। এ প্রকল্পের সমীক্ষা ও বিস্তারিত ডিজাইন তৈরির কাজ শুরু হয় ২০০৯ সালে, যা শেষ হয় ২০১৪ সালে (বাংলা নিউজ২৪, ১ জুলাই ২০১৮) এ থেকে উৎপাদিত হবে ১১৩ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ।
এ ব্যারাজের মাধ্যমে ধরে রাখা পানি চ্যানেলে সরবরাহ করে ২৬ জেলায়, ১৬৫ উপজেলার কৃষিকাজে সেচের জন্য ব্যবহার করা হবে, যার সুফল দেশের ৩৭ শতাংশ জনগণ ভোগ করবে। গবেষকদের মতে, চালু হওয়ার পর সাত বছরেই বিনিয়োগকৃত অর্থ উশুল হবে।
প্রস্তাবিত ডিজাইন অনুসারে প্রকল্পটির প্রধান কার্যক্রম হচ্ছে ২ হাজার ১০০ মিটার দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট মূল ব্যারাজ, ৭৮টি স্পিলওয়ে, একটি নেভিগেশন লক, দুটি ফিসপাস ও অন্যান্য স্থাপনা।
অপর দিকে এ প্রকল্পের আওতায় গড়াই অফটেক স্ট্রাকচার তৈরি করা হবে, যার দৈর্ঘ্য হবে ৩৯০ মিটার। এখানেও ১৫টি স্পেলওয়ে, একটি নেভিগেশন লক ও একটি হাইড্রোপাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন করা হবে।
ধারণ করা পানি থেকে ব্যারাজের মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে ২ হাজার মিলিয়ন কিউসেক মিটার পানি সরবরাহ করা হবে। প্রকল্পের ডিপিপি থেকে জানা গেছে, ব্যারেজের দুই পাশের ৮টি সংযোগ খালের মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে এই পানি ছাড়া হবে।
এর ফলে পদ্মানির্ভর ১৬টি নদী শুষ্ক মৌসুমে ফিরে পাবে নাব্যতা। যার ফলে বছরে ২৫ লাখ মেট্রিক টন বাড়তি ধান এবং ১০ লাখ টন অন্যান্য ফসল উৎপাদন হবে। মৎস্য উৎপাদন বাড়বে ২ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন। সব ব্যারাজেই পরিবেশের ক্ষতি কমবেশি হয়। কিন্তু বর্তমানের অবস্থা সুন্দরবনের লবণাক্ততা কমবে ৩৩ শতাংশের মতো (বাংলাদেশ ইকোনমিক অ্যাসোসিয়েশন)।
২. তিস্তা মহাপ্রকল্প: প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে, প্রকল্প পরিকল্পনা ও নদী পর্যবেক্ষণ কাজ দুই বছর ধরে করেছে চীনের প্রতিষ্ঠান চায়না পাওয়ার ও চায়না রিভার ইয়েলো। ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ২০০ কোটি টাকা।
তিস্তা ড্রেজিং করে কোটি কোটি মানুষের দুঃখ ঘোচানো হবে। এ প্রকল্পে ১০৮ কিলোমিটার নদী খনন, নদীর গভীরতা বাড়বে ১০ মিটার, নদীর দুই পাড়ে ২২০ কিলোমিটার তীররক্ষা, চর খনন, বালু সরিয়ে কৃষিজমি উদ্ধার।
এ প্রকল্পের সুবিধা নিয়ে প্রতিবছরে ২০ হাজার কোটি টাকার ফসল উৎপাদন হবে। তিস্তা মহাপরিকল্পনায় তিস্তার শাখা নদী এবং উপনদীগুলো আগের প্রাণপ্রবাহে ফেরানোর ব্যবস্থা থাকবে (বাংলা ট্রিবিউন ৩ আগস্ট ২০২৩)। ভারতের আপত্তিতে এই প্রকল্পও আটকে গেছে।
৩. খাল খনন: আমাদের কতটি খাল আছে, তা নিয়ে আসলে তথ্য খুঁজে পাওয়া বেশ দুষ্কর। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮১ সালের মে মাস পর্যন্ত সারা দেশে দেড় হাজারের বেশি খাল খনন করা হয়। দৈর্ঘ্য প্রায় ২৬ হাজার কিলোমিটার খাল দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খনন ও পুনঃখনন করা হয় (প্রথম আলো, ৩০ মে ২০২৩)।
ভেনিস শহর তাদের খনন করা খালকে কীভাবে বাণিজ্যিকীকরণ করেছে, আর আমরা করেছি দখল। শুধু ঢাকাতেই একসময় ৭৬টি খাল ছিল, এখন তার থেকে ২৬টি উদ্ধারের চেষ্টা করা হচ্ছিল (যায়যায়দিন, ১০ জানুয়ারি ২০২১)। অন্যগুলোর খবর নেই।
কুমিল্লার ফেনীরও ৮০ শতাংশ খাল হারিয়ে গেছে। ফলাফল আমরা এবার দেখতে পাচ্ছি। সব কটি খাল উদ্ধার করে খনন করলেই হবে, নতুন কিছু করা লাগবে না। এটি হতে পারে স্বেচ্ছাশ্রম বা কাবিখার মাধ্যমে। এর ফলে জলাবদ্ধতা কমে যাবে। স্বল্প খরচে রাবার ড্যাম দিতে পারলে শুষ্ক মৌসুমেও পানি থাকবে। পানির ধারণক্ষমতা বাড়লে কৃষিতে ফলনও বাড়বে, আর কমবে দেশের তাপমাত্রা। আর রাস্তার দুই পাশে হাঁটার জায়গা, গাছ লাগানো এবং মাছের চাষ থেকে হবে আলাদা উপযোগিতা।
এসব প্রকল্পের বাস্তবায়নের সফলতা দেখে সিলেটের টিপাইমুখী ও কুমিল্লার গোমতী নদীতে প্রজেক্ট নেওয়া যেতে পারে।
অভ্যন্তরীণ সক্ষমতা বৃদ্ধি
এবারের ফেনীর পূর্বাভাস কানাডায় অবস্থানরত গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ আগাম সতর্কবাণী দিয়ে যাচ্ছিলেন, সেখানে প্রায় ১ হাজার ২০০ জনের আবহাওয়া অফিস চরমভাবে ব্যর্থ। আমাদের নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট বা পানি উন্নয়ন বোর্ডও তাদের মনিটরিংয়ে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। আমাদের নদীগুলোর জন্য ড্রেজিংয়ে যাঁরা দুর্নীতি করেছেন এবং খাল দখলে যাঁরা জড়িত, তাঁদের শাস্তি দিতে হবে।
নতুনভাবে সব সরকারি অফিস গঠনের মাধ্যমে সব নদীর ড্রেজিং নিশ্চিত করতে হবে এবং খাল উদ্ধার করতে হবে। আমাদের সরকারি কর্মচারীদের তাদের ব্যর্থতার দায় নিতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। আর একটা কাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ, আমাদের স্কুল–কলেজের শিক্ষাক্রমে উদ্ধারকাজ প্রশিক্ষণ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এটা শুধু বন্যা নয়, যেকোনো দুর্যোগের জন্যই প্রয়োজন। আমাদের ফায়ার সার্ভিসকে আরও দক্ষ এবং লোকবল বাড়ানো লাগবে।
ওপরের সব কটি কাজের সক্ষমতা বাংলাদেশেরই আছে। আর সরকার যদি চায়, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেই আমাদের নদী বা পানি নিয়ে যাবতীয় সমস্যা সমাধান সম্ভব। আর এ ব্যাপারে কাজ করার জন্য দক্ষ জনবল আমাদের দেশের মধ্যেই আছে, শুধু দরকার সদিচ্ছা।