আমরা কেন পারি না? কী করলে পারব?

ভারত চাঁদে চন্দ্রযান পাঠানোর পর আমাদের দেশের খুব হট টপিক হয়েছিল, ‘আমরা কেন পারি না?’ছবি : এএফপি

ভারত চাঁদে চন্দ্রযান পাঠানোর পর আমাদের দেশের খুব হট টপিক হয়েছিল, ‘আমরা কেন পারি না?’ আসলেই তো, পাশের দেশ নিজেদের প্রযুক্তি দিয়ে একের পর এক অভিযান চালাচ্ছে, আমরা কোথায়?

আমরা বিশ্বের ২৫তম অর্থনীতির দেশ, জনসংখ্যার দিক থেকে অষ্টম, কিন্তু বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান কোথায়?

২০২২ সালে প্রকাশিত গ্লোবাল ইনোভেশন স্কেলে দেশের অবস্থান ১০২ থেকে ১৩২ দেশের মধ্যে। এখানেই আসলে আমাদের সবাই পিছিয়ে। কিন্তু এ রকম তো হওয়ার কথা ছিল না। কেন হলো?

স্বপ্ন: এই পয়েন্ট আসলে সব মানুষের জন্যই প্রযোজ্য। মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। আর আমাদের দেশের সামাজিক পরিস্থিতি এমন যে আমরা স্বপ্ন দেখতে ভুলে গেছি। আমাদের দেশের বাচ্চাদের ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখা ভুলিয়ে দিই আমরা। তাদের শেখাই প্রকৌশলী, চিকিৎসক, অ্যাকাউন্ট্যান্ট বা সময়ের ক্রেজ বিসিএস ক্যাডার হতে হবে বা বিদেশ চলে যেতে হবে।

এখন পর্যন্ত শুনিনি কেউ বলছে, ‘আমি গবেষক হব।’ আমরা স্বপ্ন দেখতে ভুলে যাওয়া জাতি, নিজেদের জানার বাইরে কেউ কিছু করতে গেলে বরং তাঁকে হতাশ করার জন্য যা করার তা-ই করি। সবাই যদি একই কাজ করি, এখনকার মতো সব বাইরে থেকেই এনে করা লাগবে, দেশকে স্বাবলম্বী করবেন কে? তাক লাগানো আবিষ্কার দিয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করবেন কে? এই ভিশন নিয়ে আসতে হবে স্কুলজীবনেই। কিন্তু যেখানে শিক্ষকেরাই বেতনের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘোরেন, সেখানে তাঁরা অন্যকে কী শিক্ষা দেবেন?

এ লক্ষ্য ঠিক করার প্রয়াস কিছুটা হলেও শুধু নটরডেম কলেজের মধ্যেই দেখেছিলাম। সরকারেরও দেশের এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে নিয়ে কোনো ভিশন নেই।
সিলেবাস-ব্যবস্থা: এখন চলছে এআই টেকনোলজি। আমাদের সিলেবাস কি সেই এআই প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলানো?

এখানে দুই ভাগে সিলেবাসের পরিবর্তন দরকার হয়—ক) বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবর্তন এবং খ) দেশের কর্মমুখী শিক্ষার সঙ্গে পরিবর্তন। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আনুপাতিক হারে মেধাবী শিক্ষার্থীরা বেশি যান। কিন্তু তাদের সিলেবাস আপডেট প্রক্রিয়া অনেক ধীর। কিন্তু এখান থেকে একটা বড় অংশ বিদেশে পড়তে যাচ্ছেন। আর তাঁদের অনেক জিনিস নতুন করে শেখা লাগছে। ‘রিসার্চ মেথডোলজি’ সিলেবাসটা না থাকাতে তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবেদন করার সময় বেশ ভুগতে হয়। এখনকার সব বিশ্ববিদ্যালয়েরই বিদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। তাই বছরের শুরুতেই তাদের সঙ্গে মিলিয়ে সিলেবাসের আপডেট করে নেওয়া কি খুব কঠিন?

কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় একটা ইন্ডাস্ট্রি অ্যাডভাইজর প্যানেল দিয়ে তাদের সিলেবাস দেশের কর্মমুখী শিক্ষার সঙ্গে মিলিয়ে ঠিক করে নেয়। এ ছাড়া তাদের থাকে তৃতীয় বর্ষের পর ইন্ডাস্ট্রিয়াল সংযুক্তি এবং চতুর্থ বর্ষ শেষে ইন্টার্নশিপ—দুটিই দরকার।
কিন্তু অনেক জায়গায় ইন্টার্নশিপ থিসিস বাদ দিয়ে করানো হয়। বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের দেশের জন্য দুটিই দরকার এবং তা সিলেবাসে থাকতে হবে। কারণ, অনেক ছেলেকেই দেখছি চার পাঁচ বছর চাকরি করার পর আবার বিদেশে পড়তে যাচ্ছেন। আমাদের পড়ানো হচ্ছে অযথা অনেক থিওরি, যা মুখস্থনির্ভর। অথচ দেশে আসলে আধুনিকতা, গবেষণা ও কর্মমুখী সমন্বয়ের অভাব আছে।

এখন অনেকেই বলেন, সরকার এসব জানে না—কথাটা ভুল। বেশ কিছু কনফারেন্সে যাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে জানি, সরকারি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বেশ পরিষ্কার ধারণা আছে, কী কী করা লাগবে। কিন্তু তারা তা বাস্তবায়ন করতে পারছে না। সেই রকম অন্য দেশের মানুষদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলি, দেশের মানুষ কাজ পারে।

গবেষণা: আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণা খাতে মোট খরচের মাত্র ২ শতাংশ বরাদ্দ রাখে। এর মধ্যে অনেকের আবার এই বরাদ্দও রয়ে যায়, অর্থাৎ এ বরাদ্দের পুরো অর্থ খরচ করা হয় না। তাহলে এই জাতি নতুন কিছু গবেষণায় কীভাবে যাবে? সায়েন্টিফিক বাংলাদেশ ডটকমের ভাষ্যমতে, ২০২২ সালে আমাদের দেশে মাত্র ১২ হাজার ৮৪৩টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে ভারতের ২০২০ সালেই ছিল ১ লাখ ৯১ হাজার ৫৯০টি। আমরা কত পিছিয়ে আছি, এখান থেকেই দেখা যায়। ভারতের বাজেটে গবেষণার জন্য আলাদা খাত থাকে। আর আমাদের পুরো শিক্ষা খাতে এ বছরের বাজেটে জিডিপির মাত্র ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ (ডেইলি স্টার, ১৬ জুন, ২০২৩) রাখা হয়েছে। ইউনেসকো এ খাতে ৭ শতাংশ বরাদ্দ দিতে বললেও ন্যূনতম দাবি ছিল ৫ শতাংশ। এই বিশাল বাজেটে আলাদা করে গবেষণা খাতের কথা উল্লেখ থাকে না।

এদিকে দেশের যা গবেষণা হয়, তার কোনো সেন্ট্রালাইজ ব্যাংক নেই। আমি এটা নিয়ে খুঁজতে গিয়ে একটি ওয়েবসাইট পেলাম পিবার্তা ডটকম নামে, যারা ২০১৫ সালের দিকে সব সেন্ট্রালাইজ করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সহযোগিতা না পাওয়া ও তহবিলের সমস্যার জন্য বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সমস্যা হলো, একই গবেষণা দেখা যায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে হচ্ছে, যা সময় ও খরচ দুটোরই অপচয় ঘটাচ্ছে।

গবেষকদের সম্মান না পাওয়া: আমাদের দেশের গবেষকদের আমরা কি চিনি? দেশে এখন অনেক পোস্টডক্টরেট আছেন, যাঁরা বিদেশে খুব সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন। তাঁদের কজনকে চিনি? কিছুদিন আগে প্রবাসী এক বন্ধুর কাছে শুনেছিলাম, যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা খাতে বাংলাদেশের অনেক শিক্ষার্থী সফল হয়েছেন, দেশে যাঁদের কোনো পরিচিতি নেই, প্রচারণা নেই। কিন্তু মিডিয়ায় যদি প্রচারণা থাকত, তাহলে অনেকে অনুপ্রাণিত হতে পারতেন। যেহেতু দেশ থেকে দেখা হচ্ছে না, তাঁদের গবেষণাকাজের সুফলও আমরা নিতে পারছি না।

সরকারি কাজে ঠিক স্থানে ঠিক লোক না থাকা: ভারত চাঁদে চন্দ্রযান পাঠানোর পর আমাদের একটা তুলনা ঘুরে বেড়াচ্ছে ফেসবুকে, তাদের মহাকাশ গবেষণার দায়িত্বে মহাকাশ বিষয়ে পাস করা প্রকৌশলী আর আমাদের এখানে আছেন একজন কৃষিবিজ্ঞানী। আমাদের দেশে সবচেয়ে ভালো হচ্ছে কৃষি গবেষণা। আর সেখানে আসলে কৃষি গবেষকেরাই কাজ করেন। শুধু গবেষণা নয়, করোনায় দেশের মানুষদের বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করেছিল কৃষি। এখানে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বেও আছেন একজন কৃষিবিদ। কিন্তু অন্য মন্ত্রণালয়গুলো এদিকে পিছিয়ে আছে। সরকার এ ব্যাপারে কি নিজের নীতি ঠিক করবে?

নিজেদের সক্ষমতা না বাড়ানো এবং দুর্নীতি: আর একটা মিম ফেসবুকে ঘুরে বেড়াচ্ছিল—ভারতের চন্দ্র বিজয়ের খরচ বাংলাদেশের মাওয়ার চার কিলোমিটার রাস্তা বানানোর খরচের সমান। আমাদের দেশের সব প্রজেক্টের খরচ অন্য অনেক দেশের তুলনায় বেশি। এর দুটি কারণ—দেশের নিজস্ব সক্ষমতা না থাকা এবং দুর্নীতি। এতগুলো মেগা প্রজেক্ট হয়ে যাওয়ার পর দেশের সক্ষমতা অর্জন করা উচিত ছিল। কিন্তু তা হয়েছে কি? তাহলে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বিশাল কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে অন্য বিমানবন্দরের কাজ নিজেরাই করতে পারতাম। আমাদের আমদানিনির্ভর সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে পারতাম।

আমাদের এখনো কিছু হলে চিকিৎসা নিতে দৌড়াতে হয় বিদেশে। তাহলে দেশে যে শতাধিক মেডিকেল কলেজ আছে, তারা কী করছে? দেশে এত এত বেকার, কিন্তু আমাদের দেশে বিদেশিও কম নেই। নিজেদের লোকদের দক্ষতা বাড়ানো কি যেত না? আর দুর্নীতি কমানোর ইচ্ছা কি সরকারের আছে? তাহলে এত দিনে একজনেরও কেন শাস্তি হলো না দুর্নীতির জন্য। দুর্নীতিবাজেরা নিজেদের সুবিধার জন্যই অন্যকে আগাতে দেন না।

কর্মক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারা: দেশে প্রায়ই দেখা যায় চিকিৎসক-প্রকৌশলীকে মারার ঘটনা। এর কোনো বিচার হতে দেখা যায় না। কাজ করতে গিয়ে কারও যদি আহত হওয়ার ভয় থাকে, তিনি কেন কাজ করবেন? শিক্ষাক্ষেত্রেও রয়েছে এর থাবা। শিক্ষক-ছাত্ররা নিয়োজিত আছেন দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতিতে। এই রাজনীতি কি ভালো কিছু দিচ্ছে? এ রাজনীতি তো বন্ধ করা দেশের বেশির ভাগ মানুষেরই দাবি।

সরকার, একাডেমিশিয়ান ও বেসরকারি খাতের সমন্বয়হীনতা: আমাদের সরকারি সব কাজের ক্ষেত্রে আমলারা সিদ্ধান্ত নেন। আমাদের অনেক ভালো একাডেমিশিয়ান ও বেসরকারি খাতের বিশেষজ্ঞ দেশে-বিদেশে আছেন। সব কাজ যদি সবাই মিলেমিশে করতে পারি, দেশের জন্য ভালো হবে।

এখন অনেকেই বলেন, সরকার এসব জানে না—কথাটা ভুল। বেশ কিছু কনফারেন্সে যাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে জানি, সরকারি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বেশ পরিষ্কার ধারণা আছে, কী কী করা লাগবে। কিন্তু তারা তা বাস্তবায়ন করতে পারছে না। সেই রকম অন্য দেশের মানুষদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলি, দেশের মানুষ কাজ পারে।

আমাদের মানুষ অনেক পরিশ্রমী। কিন্তু তারা সুযোগ পায় না, আর অভাব যোগাযোগদক্ষতার। এখন দুই পক্ষ যদি এক হতে পারে, তখন হয়তো আমরা ভিশনারি কাজ নিয়ে এগিয়ে যেতে পারব।

বিস্তারিত পড়ুন প্রথম আলোতে

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top