উন্নয়ন নয়, সময় এখন সংস্কারের

এক দশক ধরে বাংলাদেশে চলছে উন্নয়নের বয়ান। দেশের উন্নয়ন বলতে আসলে কী বুঝি? শুধু দেশের রাস্তাঘাটের উন্নয়ন হলেই হবে, যা একদিক থেকে বানানো হবে, অন্যদিক থেকে নষ্ট হবে? অথবা অনেক অনেক বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র হবে, যার উৎস কী হবে জানি না আমরা? নাকি দেশ হবে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি কোটিপতি উৎপাদনকেন্দ্র? হ্যাঁ! এগুলো যদি উন্নয়ন হয়, আমাদের দেশের আসলে উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু এগুলো আসলেই কি উন্নয়ন?

এক.

‘প্রয়োজন’ ধারণা, বিশেষ করে বিশ্বের দরিদ্র মানুষেদের অপরিহার্য চাহিদা, যাকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।

দুই.

বর্তমান ও ভবিষ্যতের চাহিদা মেটাতে পরিবেশের ক্ষমতার ওপর প্রযুক্তি এবং সামাজিক সংগঠনের রাষ্ট্র দ্বারা আরোপিত সীমাবদ্ধতার ধারণা।’ (বিশ্ব পরিবেশ ও উন্নয়ন কমিশন, আমাদের সাধারণ ভবিষ্যৎ ১৯৮৭)

আমাদের দেশের সব উন্নয়ন কি দরিদ্র মানুষের কথা মেনে করা হয়েছে? পরিবেশ নিয়ে কতটা কাজ হয়েছে? এত এত উন্নয়নের ফল হয়েছে—আমাদের দরিদ্র মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে সবকিছু, যা প্রথম শর্তই ভঙ্গ করা হয়েছে। শুধু কি দরিদ্র জনগোষ্ঠী? অর্থনীতি সমিতি তাদের ছায়া বাজেট আলোচনায় দেখিয়েছিল, উন্নয়নের সঙ্গে মধ্যবিত্ত শ্রেণি যেখানে আরও বাড়তে পারত, সেখানে নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণি হারিয়ে যাচ্ছে।

এসব তো গেল সংজ্ঞার প্রথম অংশ। উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে পরিবেশের প্রশ্নটি গৌণ। দেদার গাছ কাটা হচ্ছে, সুন্দরবনের পাশে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলো। কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র যেখানে বিশ্বের সবাই কমিয়ে ফেলছে, সেখানে আমাদের বড় অংশ আসছে কয়লা থেকে। স্বল্প সময়ের উন্নয়ন দেখাতে গিয়ে ভবিষ্যৎ মানুষের কথা কেউ কি ভেবেছে? অন্তত লক্ষণ দেখা যায় না।

উন্নয়ন করতে গিয়ে আমাদের মাথাপিছু ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। শোধ কীভাবে দেওয়া হবে, কোনো পরিকল্পনা নেই। আমরা তৈরি করছি অলিগার্কিদের, যারা টাকা পাচার করেই চলেছে আর ব্যাংক খাতকে করে দিয়েছে নড়বড়ে। ওদের কাছ থেকে ব্যাংকঋণ আদায়ের চেষ্টা দেখা যাচ্ছে না; বরং তথ্য গোপন করে বাঁচানো হচ্ছে।

উন্নয়নের আগে দরকার পুরো দেশের সংস্কার। ইউরোপ যখন তাদের অন্ধকার যুগ শেষ করে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল, সব খাতেই এসেছিল সংস্কার। সংস্কার চলমান প্রক্রিয়া। কিন্তু তার জন্য দরকার ঐকমত্য ও পরিকল্পনা। যার ফল এখন আমরা দেখি—

ইউরোপের ইতিহাস দেখলেই বোঝা যায়, তাদের ছোট ছোট পরিবর্তন আজ কোথায় নিয়ে এসেছে। আমাদের দেশও এখন তার প্রান্তসীমায় উপস্থিত। সমস্যা হচ্ছে, আমরা যে ইউরোপের মতো ঘুরে দাঁড়াতে পারব, তা মানুষের স্বপ্নে নেই; বরং সবকিছুতেই রয়েছে হতাশা।

কিছু উদাহরণ দিই সংস্কারের। প্রথমেই ধরি আমাদের সংবিধান। দেশের সব রাজনৈতিক সমস্যার পেছনে সংবিধানের দোহাই বা সংবিধান অস্বীকারের বিষয়গুলো রয়েছে। এসব কারণে সংবিধান পর্যালোচনা ও সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া একটি জরুরি বিষয়।

এই দেশ স্নাতক বেকার তৈরিতে বিশ্বের প্রথম সারিতে থাকবে। কিন্তু যুগোপযোগী শিক্ষা কি তাঁরা পাচ্ছেন? বিশ্বে আমরা পরিচিত শ্রমিক পাঠিয়ে। এত শিক্ষিত বেকার কি বাইরে আমাদের মুখ উজ্জ্বল করতে পারতেন না? মেধাবীরা চলে যাচ্ছেন। তার পরের স্তরে যাঁরা আছেন, তাঁরা সরকারি চাকরি খুঁজছেন, অন্যদের কী অবস্থা?

বেসরকারি খাতে এখন বলা হচ্ছে, মনমতো প্রার্থী পাচ্ছি না। এত বিশ্ববিদ্যালয়, ভালো মানের গবেষণা কেন নেই? কেন প্রশ্ন করা হচ্ছে না? বিসিএসের শিক্ষা ক্যাডাররা যাচ্ছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস নিতে। তাঁরা মেধাবী। কিন্তু তাঁদের কাছ থেকে পাস করা ছাত্রছাত্রীরা কেন মেধাবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছেন না? শিক্ষকেরা কি নিজেদের প্রশ্ন করেছেন? এই শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আমরা দিন দিন পিছিয়েই পড়ব; সংস্কার খুব জরুরি।

বিমানবন্দর থেকে শুরু করে দেশের সব খাতেই সংস্কার দরকার। আমাদের পিঠ ঠেকে গেছে। লিখতে গেলে শেষ করা যাবে না। এখন তাই বলতেই পারি—অনেক হয়েছে উন্নয়ন, এখন প্রয়োজন সংস্কার। উন্নয়ন হতে হবে গণমানুষের, মুষ্টিমেয় মানুষের নয়। আর তাদের পাপের বোঝা আমরা বহন করতেও রাজি নই

স্বাস্থ্য খাত বললেই চলে আসে দুর্নীতির কথা। সবাই কিছু হলেই বিদেশ ছোটে। আমাদের মন্ত্রী-সংসদ সদস্যরা তো দেশে চিকিৎসা নেনই না। তাঁদের সবার আগে বাইরের চিকিৎসা নেওয়া বন্ধ করতে হবে; তাহলে যদি এই খাতে উন্নতি হয়। দেশে সব জেলায় মেডিকেল কলেজ হচ্ছে, কিন্তু সবাই সব চিকিৎসা পেতে পারে—এ রকম হাসপাতাল নেই কেন? এই খাতকেই করে রাখা হচ্ছে পরমুখাপেক্ষী।

দেশের সবচেয়ে বেশি খরচের খাত হচ্ছে সরকারি বেতন-ভাতা ও পেনশন। বিশ্বের সব উন্নত দেশই তাদের বেশির ভাগ অপ্রয়োজনীয় খাতকে বেসরকারীকরণ করেছে—নিজেদের আয়ে নিজেরা চলো। কিন্তু আমরা বেসরকারি খাতকে নষ্ট করে করে সবকিছুর মুখাপেক্ষী করে রাখছি সরকারি খাতকে।

এই খাতের পুরোপুরি আধুনিকায়ন প্রয়োজন। আমি বাংলাদেশি নাগরিক বলে দেশের যেকোনো অফিস থেকে সেবা পাওয়ার যোগ্য। কেন অমুকের ভাই, তমুকের আত্মীয় বা অমুক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আছি বলে অথবা কোথাও কোথাও টাকা দিয়ে সেবা নিতে হবে?

এ দেশের আসল সুবিধা হলো স্বল্প খরচে শ্রমিক পাওয়া যায়। তাহলে আমাদের দেশের রাস্তা, সেতু, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সবচেয়ে দামি কেন হবে? আমাদের পাশের দেশ ভারত থেকে কয়েক গুণ বেশি। কেন? খাদ্যদ্রব্যের বাজারে এত সিন্ডিকেট—সরকার যাদের চিনেও ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন?

বিমানবন্দর থেকে শুরু করে দেশের সব খাতেই সংস্কার দরকার। আমাদের পিঠ ঠেকে গেছে। লিখতে গেলে শেষ করা যাবে না। এখন তাই বলতেই পারি—অনেক হয়েছে উন্নয়ন, এখন প্রয়োজন সংস্কার। উন্নয়ন হতে হবে গণমানুষের, মুষ্টিমেয় মানুষের নয়। আর তাদের পাপের বোঝা আমরা বহন করতেও রাজি নই।

বিস্তারিত পড়ুন প্রথম আলোতে

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top