শীত যত এগিয়ে আসছে, তত শোনা যাচ্ছে বিভিন্ন জায়গায় আগুন। প্রতিবছর আগুন লাগা আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকার মধ্যে হলে আহা উহু করি এবং তারপর ভুলে যাই। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও আমাদের যেকোনো দুর্যোগ বা দুর্ঘটনা থেকে স্বাভাবিকভাবে উদ্ধার পাওয়ার ব্যবস্থা তৈরি করতে পারিনি।
যেকোনো দুর্যোগ-দুর্ঘটনাতে আমাদের সবার আগে নাম আসে ফায়ার সার্ভিসের। কিন্তু এই সংস্থা কতটা প্রস্তুত? ফায়ার সার্ভিসের ওয়েবসাইট অনুসারে, তাদের সেন্টার আছে সারা দেশে ৪৯০টি। প্রস্তাবিত জনবল ৩১ হাজার ১৬৯ জন। তাদের সর্বমোট ইকুইপমেন্ট বা যন্ত্রপাতি আছে ৪ হাজার ৩৯৪টি মাত্র। সরকারি হিসাবের ১৬ কোটির দেশে এই সংখ্যা কতটা অপ্রতুল, তা বোঝাই যায়। এখনো দেশের সব উপজেলায় ফায়ার ব্রিগেডের সেন্টার নেই। তবে এই সীমিত লোকবল নিয়েই এই সংস্থা চেষ্টা করছে। তারা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বেচ্ছাসেবী তৈরির চেষ্টা করছে। এখন পর্যন্ত ৪৪ থেকে ৪৮ হাজার মানুষকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে, যা ৬০ হাজারে উত্তীর্ণ করা হবে।
এখন দেখি সংস্থাটি অত্যাধুনিকতার সঙ্গে কতটা প্রস্তুত? রানা প্লাজার ঘটনা ঢাকার কাছে, আমাদের কাজ ছিল চরম ধীরগতির। ১০০০–এর ওপর মানুষ মারা গেল। বনানীর অগ্নিকাণ্ডে আমাদের মই একটা সীমার পর উঠতে পারল না। চট্টগ্রামে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে রাসায়নিক বিস্ফোরণের আগুনে অপ্রস্তুতির জন্য কতগুলো তাজা প্রাণ হারিয়ে গেল। এমনকি উত্তরাতে ক্রেন দুর্ঘটনাতে, সিদ্ধান্তহীনতায় মারা গেল ছয়জন। পুরান ঢাকা বা গার্মেন্টসগুলোয় আগুন লাগলে যানজট বা রাস্তার অপ্রতুলতার কারণে পৌঁছাতে বিলম্ব তো আমাদের সবার জানা। যত সময় যায়, সমস্যাগুলোও আধুনিক হয়, আমাদের ফায়ার সার্ভিস কী সেই আধুনিক সমস্যার জন্য প্রস্তুত? ২০২১ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে মোট অগ্নিকাণ্ড হয়েছে ২১ হাজার ৬০১টি। এতগুলো দুর্ঘটনা সামলানোর ক্ষমতা কি আমাদের আছে? দেশের যেকোনো ইমার্জেন্সি সার্ভিসে আমাদের সেনাবাহিনীকে ডাকা লাগে, লঞ্চডুবি হলে নৌবাহিনীকে। এটা তো হওয়ার কথা নয়।
এরপর আসি ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস নিয়ে। এবারের সিত্রাং নিয়ে পূর্বাভাস দিতে গিয়ে সমালোচিত হয়েছে আবহাওয়া বিভাগ। যেখানে আবহাওয়া পূর্বাভাসের বৈশ্বিক মডেলগুলো ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ওয়েবসাইটে দেখা যাচ্ছিল, সিত্রাং বাংলাদেশে প্রবেশ করছে, আমাদের আবহাওয়া বিভাগ তখনো অন্ধকারে। ৩৫ জন মানুষ নিহত হওয়ার খবর পত্রিকা মারফত জানা যায়, আবহাওয়া বিভাগের এই দুর্ঘটনার জন্য কি একটুও দায় নেই? আবার ঘূর্ণিঝড়ের পর যে জলাবদ্ধতা হয়, তা সরানোর জন্য কি আমাদের আধুনিক বাঁধ প্রস্তুত? তারা যে প্রস্তুত নয়, তা সিলেটের বন্যার সময়ই জানা গেছে।
প্রতিদিন যানজটে কত অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক ঘণ্টার মধ্যে রোগীকে আনতে পারলে বাঁচানো যায়, কিন্তু ঢাকাতে কোনো রোগীকে যত চেষ্টাই করা হোক না কেন, কয়েক ঘণ্টার আগে নিয়ে আসা যায় না। এই দেরির জন্য কতজন মারা যাচ্ছে বা প্যারালাইজড হচ্ছে, আমাদের কারও কোনো চিন্তা নেই।
দেশে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে। উদ্ধার করে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারলে বেঁচে যাওয়ার সুযোগ থাকে। কিন্তু পুলিশি ঝামেলার জন্য অনেকেই সেই ঝামেলা নিতে চায় না। ব্রিটিশ আমলের এই ধারার কি বদল সম্ভব নয়? মানুষের জীবনের মূল্য তো সবার থেকে বেশি। আর সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে অনেকেই কথা বলছে, কিন্তু কোনো লাভ দেখা যাচ্ছে না।
এখন আসি দেশের উঁচু উঁচু দালানের নিরাপত্তা নিয়ে। বেশির ভাগ দালানেই যে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র থাকে, তার মেয়াদ থাকে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নেই আলাদা সিঁড়ির ব্যবস্থা। থাকলেও তা বেশির ভাগ সময় থাকে বন্ধ, থাকে না পানির ব্যবস্থা। তাহলে? এগুলো দেখা যাঁদের দায়িত্ব, তাঁরা কোথায় থাকেন?
২০১৫ সালে নেপালে ভূমিকম্পের পর দেশে অনেকগুলো ছোট ছোট ভূমিকম্প অনুভূত হয়। যদি আমাদের দেশে নেপালের মতো ভূমিকম্প আসে, আমাদের উদ্ধারের কী অবস্থা? এই বিল্ডিংয়ের জঙ্গল যদি একসঙ্গে ধসে পড়ে, যত লোক চাপা পড়ে মারা যাবে, তার থেকে বেশি মারা যাবে উদ্ধার না পেয়ে। দেশ কি ভূমিকম্প মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত? একেবারেই না।
দেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বলে একটা মন্ত্রণালয় আছে। ২০১২ সালের একটা আইন আর ২০১৫ সালের একটা নীতিমালাও হয়। কিন্তু তাদের সীমাবদ্ধতা বন্যা মোকাবিলা আর ঘূর্ণিঝড়ে আশ্রয় দেওয়া পর্যন্তই। আধুনিক নতুন নতুন সমস্যাগুলো নির্ণয় করে সেই অনুযায়ী আগে থেকে ব্যবস্থা নিয়ে রাখার ব্যাপার এই নীতিমালাতে নেই। পূর্বপরিকল্পনা অনেক ক্ষতি থেকে বাঁচিয়ে রাখে—এটা সবাই জানি।
বাংলাদেশে ১৯৮৮–এর বন্যা আর ১৯৯১–এর ঘূর্ণিঝড়ের পর নিজেদের প্রস্তুত করে এবং তার ফলে এখন দুটিতে ততটা ক্ষতি দেখা যায় না। যদিও পরিকল্পনা ছাড়া উন্নয়ন সিলেটের বন্যার প্রধান কারণ ছিল। এখন নিজেদের তৈরি করা দুর্যোগ মোকাবিলাতে আমরা চরমভাবে ব্যর্থ। আর যাদের এই সক্ষমতা তৈরি করার কথা ছিল, তারা অন্যান্য উন্নয়নের তো এদিকের কথা বেমালুম ভুলে গেছে। কিন্তু সংবিধান বলে আমি স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই। সেই গ্যারান্টি দেওয়ার জন্য আমাদের রাষ্ট্র একেবারেই প্রস্তুত নয়। আর আমাদের জন্য দেখার আসলেই কি কেউ আছে?