বিশ্বকাপের উন্মাদনা: আমাদের নিজেদের ফুটবল কই?

চারদিকে ফুটবলের ডামাডোল আর এর মধ্যে আমাদের দীর্ঘশ্বাস। বিশ্বকাপ নিয়ে সবচেয়ে মত্ত জাতি বাংলাদেশ। এত এত সমর্থন থাকা সত্ত্বেও আমাদের কোনো অবস্থান নেই। মাত্র তিন লাখ মানুষের দেশ আইসল্যান্ড এখন ইউরোপের উঠতি ফুটবল শক্তি। এবারের বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে না খেললেও ইউরোর কোয়ার্টার ফাইনালে খেলেছে তারা। বিশ্বকাপ বাছাইয়ে গ্রুপ পর্বের শক্তিধর প্রতিদ্বন্দ্বীদের পেছনে ফেলে খেলেছে ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপও। যদিও এই বিশ্বকাপে তারা নেই। আর সরকারি হিসাবে, ১৬ কোটির দেশ হয়েও আমরা কিছু করতে পারি না! আমাদের র‍্যাঙ্কিং ১৯২। আমাদের পাশের দেশ ভারতও ১০৬। আর মিয়ানমার এত ঝামেলা নিয়েও আমাদের থেকে এগিয়ে। এমনকি সাফের বাকি সব দেশও এগিয়ে যাচ্ছে, পিছিয়ে শুধু আমরা।

কাজী সালাউদ্দীন যখন ফুটবলের দায়িত্ব নেন, আশায় বুক বেঁধেছিলাম। কারণ, তাঁর মতো ফুটবলবোদ্ধা আসলেই দেশে বিরল। কোটি টাকার সুপার কাপ করে দর্শকদের মাঠমুখী করেছিলেন। মেয়েদের ফুটবল নিয়েও কিছু কাজ করেছিলেন। চমক দিলেন ২০২২ বিশ্বকাপ খেলার লক্ষ্য। সেই শেষ। সবচেয়ে বেশি র‍্যাঙ্কিংয়ের যে দল যে বিশ্বকাপ খেলছে, সেটি হলো ঘানা। তাদের র‍্যাঙ্কিং ৬১, আর আমাদের? যখন বিশ্বকাপ চলে, আর আমরা অতীতে পড়ে থাকি আর ভাবি কখন কাতারকে হারিয়েছিলাম বা মোহামেডান-ইরানের ক্লাবের সেই দ্বৈরথ। অতীতচারিতা আমাদের জাতি হিসেবে পিছিয়ে দেওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ।  

সেই ২০১২ থেকে ফুটবলের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলি, যদি ১০০ শতাংশ সততা আর গোছালো প্ল্যানিং করা যায়, তাহলে দেশের ফুটবল আমাদের সেরা র‍্যাঙ্কিং (১১০, ’৯৯ সালে) এবং এশিয়ার ২৪টি দেশের মধ্য থেকে অন্তত এশিয়া কাপ খেলতে পারে। লক্ষ্য ছাড়া কোনো কাজ সম্ভব না। দলীয় খেলা ফুটবল। এখানে উন্নতির জন্যও দরকার সমন্বিত চেষ্টা। ফেডারেশন চেষ্টা করলেই একজনকে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো তৈরি করতে পারবে না। আবার ক্লাব না দেখলেও ‘রোনালদো’ তৈরি হবে না। এখানে ফুটবলারদের সদিচ্ছা আর কঠোর পরিশ্রমের মানসিকতাও দরকার। ফেডারেশন আর ক্লাব যার যার জায়গা থেকে নিজেদের কাজটা করলেও কেউ ‘বড়’ খেলোয়াড় হতে পারবেন না, যতক্ষণ না তিনি ‘বড়’ ফুটবলার হতে চান। আরাম-আয়েশ ফেলে যতক্ষণ না ত্যাগ-তিতিক্ষার পথ বেছে নেয়। রোনালদোর দিকেই তাকিয়ে দেখুন না, কী হাড়ভাঙা পরিশ্রমই না করেন তিনি! তাই উন্নতির জন্য চাই—সব পক্ষের সমন্বিত প্রচেষ্টা। আর এই বাফুফে এবং ক্লাবগুলোর কোনো ভিশন নেই। বাইরের লিগ স্ট্রাকচার দেখে আর বাংলাদেশের অবস্থান নিজের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু আইডিয়া দিচ্ছি। কিন্তু মূল কথা, আমরা যেমন স্বপ্ন দেখি সেই স্বপ্ন সবাইকে দেখতে হবে।

বাফুফের করণীয়

সব কাজ বাফুফেকেই করতে হবে। প্রথম কাজ সব বয়সভিত্তিক দলের জন্য ভালো কোচিং স্টাফ নিয়ে আসতে হবে। ক্লাবগুলোর সঙ্গে বসে পরিকল্পনা দাঁড় করানো লাগবে। পাতানো খেলা—জি, লিগে পাতানো খেলা হচ্ছে, কান পাতলেই শোনা যায়, তা বন্ধ করতে হবে। এতে জড়িত থেকে যদি কোনো সুপারস্টার চলে যায়, যাক। এই বিষফোড়া বন্ধ না করলে কোনো লাভ নেই। রেফারিং ভালো করতে হবে। বিশ্বকাপে রেফারিং দেখলেই বোঝা যায় আমরা কোথায় এখন। বড় দলগুলো রেফারির সহায়তা পায়। কিন্তু এরা একই কাজ যখন ইন্টারন্যাশনাল লেভেলে করে, মাপ পায় না।

ক্লাবগুলোকে প্রফেশনাল করতে হবে। নিজেদের মাঠ না থাকলে কোনো নির্দিষ্ট মাঠ লিজের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। ফুটবল ঢাকা থেকে সরালেই দর্শক আসবে। বাফুফের আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ, মাঠের যথাযথ পরিচর্যা করা। যে কাজটাকে কোনো সময়ই গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। দেশের মাঠগুলোর কোনোটাই মানসম্মত নয়। বর্ষার সময়ে কর্দমাক্ত, শুকনো মৌসুমে জায়গায় জায়গায় ঘাস! কিন্তু যেসব দেশ ফুটবলের পরাশক্তি, সেখানে এমন মাঠের কথা ভাবাই যায় না। বেশ কিছুদিন আগে বায়ার্নের একটা প্রতিবেদন দেখলাম। বছর বছর মাঠের ঘাস কী রকম বদল হচ্ছে, আর তাতে খেলাটার ওপর কী প্রভাব পড়ছে, তা নিয়ে। মাঠ নিয়ে ওরা যখন এত সচেতন, তখন আমাদের তো এটা বোঝা উচিত—দিনের পর দিন একই মাঠে খেলা হলে, সে মাঠটা ভালো থাকে না!

ক্লাবদের নিজেদের আয়ে চলতে হলে নিজস্ব মার্কেটিং টিম লাগবে। বাফুফে শুধু ক্যালেন্ডার দেবে, বাকি সব কাজ ক্লাবের দায়িত্ব আর তা পালন বাফুফেকে নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি ক্লাবের নিজস্ব একাডেমি থাকতে হবে। প্রবাসী অনেক বাংলাদেশি খেলোয়াড় আছেন, যাঁরা দেশের হয়ে খেলতে চান, তাঁদের খেলানোর ব্যবস্থা করতে হবে। জামাল ভূঁইয়া, তারেক রায়হানের মতো আর পাঁচ–ছয়জন খেলোয়াড় হলেই জাতীয় দল দাঁড়িয়ে যায়। কোচকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে।

বাফুফের উচিত, সব খেলোয়াড়ের জন্য একটা ডেইলি ফিটনেস রুটিন করা, আর তাঁদের ফুড চার্ট দিয়ে দেওয়া। ক্লাবে কিংবা বাসায়, তাঁরা যখন যেখানেই থাকুন না কেন, বাধ্যতামূলকভাবে সেটা মেনে চলতে হবে। যেসব ক্লাবে জিম করার সুবিধা আছে, প্রয়োজনে সেসব জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের জন্যও কাজে লাগানো যেতে পারে। যেখানে একজন স্থানীয় ট্রেনার খেলোয়াড়দের দেখাশোনা করবে। একজন মনোবিদকেও এক বছরের জন্য নিয়োগ দেওয়া দরকার। যাতে খেলোয়াড়েরা তাঁদের যেকোনো সমস্যায় তাঁর শরণ নিতে পারেন। খেলোয়াড়দের ডায়েট কী হবে, সেটা অবশ্যই ঠিক করবেন নিউট্রিশননিস্ট। স্কিলের সঙ্গে শারীরিক আর মানসিক দুটোরই সংযোগ দরকার। আমাদের লিগে খেলা অনেক কম। তাই জাতীয় দলের অনুশীলন শুরু হলে খেলোয়াড়দের সবকিছু নতুন করে শুরু করা লাগে। এটা মাথায় রেখে বাফুফের উচিত, সব সময় মাঠে খেলা রাখা। যে সময় খেলা থাকবে না, সেই সময় ফুটবলারদের নিয়ে যেন ক্যাম্প করা হয়।

এই বেসিক বাফুফে নিজেও জানে এবং এই কমিটিতে সব থেকেও জাতীয় দলের জন্য কোচিং স্টাফ আনা ছাড়া বাকি কোনো কিছুই করতে পারেনি।

ক্লাবগুলোর করণীয়

পাতানো খেলা হলে খেলোয়াড়দের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মানসিকতাই হারিয়ে যায়। রেফারির সুবিধা পাওয়া বড় দলের খেলোয়াড়দের কাছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নিয়ম-কানুন লাগে নতুন। এই ক্লাব ফুটবল নিয়ে দেশ এগোবে না। সব দলের নিজস্ব মাঠ লাগবে, লাগবে জুনিয়র দল। খেলোয়াড়দের মাসিক বেতন দিয়ে প্রফেশনাল লেভেলে নিতে হবে। কিছু খেলোয়াড়ের পেছনে অস্বাভাবিক চুক্তি না করে সেই টাকা ফুটবল উন্নয়নে আর প্রফেশনালিজমে ব্যবহার করা। এএফসি প্রায় বিভিন্ন কর্মশালা নেয়। কিন্তু ক্লাবগুলোর সদিচ্ছা না থাকায় তা গুড়ে বালি। একটু কি খেয়াল করে দেখবেন, বিশ্বকাপে জার্সি বিক্রিতে কতটা আয় হয়? এই পুরো মার্কেটটাই দখল করা সম্ভব, যদি প্ল্যান করা যায়।

আর জুনিয়র দল তৈরির সঙ্গে সঙ্গে স্কাউটিং চালু করতে হবে। দেশের বিভিন্ন আনাচকানাচে বা দেশের বাইরের প্রবাসী ফুটবলার খুঁজে আনা ক্লাবগুলোরই দায়িত্ব। এগুলোর সঙ্গে বেসিক যে কাজ আছে যেমন কোচিং সেটআপ নিশ্চিত করা। সব দলের যেন ট্রেনার, ফিজিও আর গোলকিপার কোচ থাকে। ফিটনেসের সঙ্গে সঙ্গে নিউট্রিশনিস্ট দিয়ে ফুড হ্যাবিট, জিম, রেগুলার ট্রেনিং আর মনোবিদ দিয়ে মনোবল বাড়ানো।

খেলোয়াড়দের করণীয়

রেগুলার ফিটনেস ট্রেনিং, বাসায় থাকলে যতটুকু সম্ভব স্কিল ট্রেনিং, জিম, মনোবিদের সাহায্য নেওয়া, রেগুলার নিউট্রিশনিস্টের সাহায্য নেওয়া—কত কী? ভার্চ্যুয়াল লাইফে অযথা সময় নষ্ট না করে ভিডিও দেখে স্কিল বাড়ানো যায়। বই পড়েও ফুটবল নিয়ে জানার অনেক কিছু আছে। এটা খেলোয়াড়ি পেশাদারির মধ্যেই পড়ে। মনোযোগের অভাবে জাহিদের মতো প্রতিভাও হারিয়ে গেছে। কিন্তু শুধু পরিশ্রম দিয়েও টিকে আছে অনেকেই। এখানে সাবেক ফুটবলার আমিনুল হককে টেনে আনা যেতে পারে। ইনজুরি থেকে মাঠে ফিরে কী পরিশ্রমটাই না করতেন তিনি। ক্রিকেটের তাসকিন এখনকার উদাহরণ। ফুটবলারদের দম না থাকার একটা কারণ অনেকে মাদক বলে থাকে, তা থেকে দূরে নিজেদেরই থাকতে হবে।

সংবাদমাধ্যমের করণীয়

সংবাদমাধ্যমেরও করণীয় আছে শুনে অবাক হচ্ছেন? বাংলাদেশে ফুটবল নিয়ে সাংবাদিকতা আসলেই অনেক পিছিয়ে আছে। ফুটবল নিয়ে রিপোর্টিং মানে শুধু ম্যাচ রিপোর্ট না। সাপ্তাহিক অ্যানালাইসিস, ম্যাচ ডে অ্যানালাইসিস, অনেক কিছুই আছে। আমরা সেখানে বেশ পিছিয়ে। একটা-দুটি ম্যাচে ১০-১৫ মিনিট ভালো খেললেই একটা হাইপ উঠিয়ে দেওয়া হয়। বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের ফুটবল অনেক অনেক পিছিয়ে। সাফেও আমরা ৪ নম্বরে। বাস্তবতার জমিনে পা রেখেই এগোতে হবে আমাদের। আবার টিভিতে ঘরোয়া লিগ রেগুলার দেখানো, প্রচারণা ও টিভি মিডিয়ার দায়িত্ব।

সমর্থকদের করণীয়

আমাদের ঘরোয়া ফুটবলের সঙ্গে থাকতে হবে। আমাদের প্রেশার ক্রিয়েট করতে হবে বোর্ড, ক্লাব এদের প্রতি। জবাবদিহি না থাকায়, টানা ক্ষমতায় থেকেও ফুটবল শুধু পিছিয়েই যাচ্ছে। এটাকে লাইনে নিয়ে আসতে হলে আমাদের ও দেশের ফুটবলকে ভালোবাসতে হবেই। ৪৫টি দেশের মধ্যে এশিয়ায় আমাদের অবস্থান ৪১। ২০২৭-এর এশিয়া কাপ লক্ষ্য করে যদি এখন থেকেই প্রস্তুতি শুরু করি, নিজেদের ওপর আস্থা রাখি, এগোনো কি খুব কঠিন—৪১-কে ২৪টা দেশের মধ্যে আনা? আমরা আগেও তো ওই লেভেলে ছিলাম। এখন সুযোগ-সুবিধা, টাকা সব বেশি। তাহলে এখন কেন নয়?
বাফুফে, ক্লাব সবাই যদি চেষ্টা করে দিনবদলের সূচনা এই বিশ্বকাপ থেকে কেন করা সম্ভব না?

বিস্তারিত পড়ুন প্রথম আলোতে

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top