শিক্ষানীতি নিয়ে শিক্ষার্থীদের আর কত গিনিপিগ করা হবে

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা নিয়ে লেখালেখি করতে গিয়ে জানতে পারলাম, দেশের মাধ্যমিক আর নিম্নমাধ্যমিকে একটা বড় পরীক্ষা হয়ে গেছে। যার শুরু হয়েছে ষষ্ঠ আর সপ্তম শ্রেণি দিয়ে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করে ফেলাই তার লক্ষ্য। এই ব্যবস্থা চালু করতে গিয়ে সরকার থেকে বলা হচ্ছে, ফিনল্যান্ড-সিঙ্গাপুরের আদলে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে এই চেষ্টা। কিন্তু আমাদের দেশ এই শিক্ষাব্যবস্থার জন্য তৈরি কি না, সেটা কি আমলে নেওয়া হয়েছে?

প্রথমে দেখে নিই এই পরীক্ষার ফলে কী হচ্ছে? এই শিক্ষাব্যবস্থা অ্যাসাইনমেন্ট ও গ্রুপ স্টাডিভিত্তিক। আমাদের দেশের সব স্কুল কি এমন পাঠদানের জন্য প্রস্তুত? একেকটা অ্যাসাইনমেন্ট করতে খরচ হয় ২০০ থেকে ৫০০ টাকা, বাংলাদেশের নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষেরা কীভাবে এই খরচ দিতে পারবে? এরপর এসব সমস্যার জন্য সবাই ফোন হাতে নিয়ে অ্যাসাইনমেন্টের উত্তর খুঁজছে। যেহেতু পরীক্ষা নেই, একবার করে ফেলতে পারলেই শেষ। বুঝে শেখার থেকে কপি করাটাই হচ্ছে আসল কাজ। ফলে শিখছে না কিছুই।

আপনারা কি একটু খুঁজে দেখবেন, ফিনল্যান্ডে ছাত্রছাত্রীদের হাতে মুঠোফোন দিয়ে অ্যাসাইনমেন্ট করানো হয় কি না? উত্তর, না। এরা এসব হাতের কাজ শিখে আসে ছোটবেলা থেকেই। তাদের মা-বাবাও এই শিক্ষাপদ্ধতির অংশ, ফলে তাঁরাও বাচ্চাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করেন। কিন্তু আমাদের বাবা-মায়েরা তো প্রস্তুত নন। এমনকি প্রস্তুত নন শিক্ষকেরাও। বিল গেটস এক সাক্ষাৎকারে বলেছিল, উনি তাঁর সন্তানদের ১৪ বছরের আগে মুঠোফোন দেননি। বিপরীতে আমরা তাদের ডিভাইসনির্ভর করে ফেলছি।

এরপর আসে রান্নাবান্নার কাজ। অবশ্যই এটা সবার শেখা উচিত। কিন্তু বাস্তবে সবাই তো বাসা থেকে রান্না করে নিয়ে যাচ্ছে। আর যা দিয়ে আসলে সবাই ভোজ করছে। কয়টা স্কুল হাতে ধরে শিখিয়েছে? শেখানো আত্তীকরণ, শুধু দেখিয়ে যাওয়া নয়। এসব অ্যাসাইনমেন্টভিত্তিক কাজ এই দেশে সফল হবে তখনই, যখন সব খরচ স্কুল বহন করবে এবং যা করার তা স্কুলের সময়ের মধ্যে শেষ করা যাবে। না হলে ডিভাইস থেকে বাঁচানো সম্ভব নয়।

এরপর আসছে গ্রুপভিত্তিক কাজ। যা হয়, একজন করে, অন্যরা কপি করে। যেহেতু একটি দলের একেকজন একেক জায়গায় থাকে, ফলে কেউ একজন দায়িত্ব নেয়, অন্যরা তাকে কপি করে। সবক্ষেত্রে না হলেও অনেক ক্ষেত্রেই এমনটি ঘটছে। ফিনল্যান্ডে ১ জন শিক্ষকের বিপরীতে ১২ জন ছাত্রছাত্রী, কিন্তু আমাদের দেশে তা ১ জনের সঙ্গে ৪২ জন। গ্রামের স্কুলগুলোয় এই ব্যবধান আরও বেশি। কীভাবে কাজ আদায় করা সম্ভব? এরপর পরীক্ষা নেই, কিন্তু আছে বিভিন্ন চিহ্ন দিয়ে রেজাল্ট দেওয়া। যেহেতু শিক্ষকের হাতেই সবকিছু, কোচিং ব্যবসা কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ হয়নি এখনো।

এরপর আসি তাত্ত্বিক অবস্থায়। এখানে বইগুলোয় তথ্য খুব কম। বইগুলার গুণগত মান আগের থেকে কমেছে। নেই বাংলা-ইংরেজি ব্যাকরণ। নবম শ্রেণির গণিত বইয়ের অধ্যায় চলে এসেছে নিচের ক্লাসের বইয়ে। বিজ্ঞান বা আইসিটি নিয়েও পড়ার জিনিস কম। ফলাফল ছাত্রছাত্রীরা পড়া ছেড়ে দিচ্ছে।

জেএসসি, পিইসি পরীক্ষা উঠিয়ে দেওয়া খুবই ভালো সিদ্ধান্ত। কিন্তু বার্ষিক পরীক্ষা কেন উঠিয়ে দেওয়া হলো? আমাদের দেশ কি এ ব্যবস্থার জন্য প্রস্তুত? সপ্তম শ্রেণির পর ক্যাডেট কলেজের পরীক্ষা, তারা কি এই কারিকুলামের ওপর পরীক্ষা নেবে? পরীক্ষাপদ্ধতি না থাকায় মেধার মূল্যায়ন হচ্ছে না। একই কারণে শিক্ষার্থীদের মনে রাখার, জানার আগ্রহ কমে যাচ্ছে। যে ছেলে পরীক্ষা দিতে জানে না, সে কীভাবে পরের পরীক্ষা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হবে?

ফিনল্যান্ডে চাকরি বা উচ্চশিক্ষার জন্য যুদ্ধ করতে হয় না। আমাদের দেশ তো তা নয়? তারা কীভাবে মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং বা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রস্তুত হবে? এর রূপরেখা কী? ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, বৃত্ত—এ মূল্যায়ন কি বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য হবে? নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলি, আমি স্নাতক আর স্নাতকোত্তর যতগুলা ডিগ্রি নিয়েছি, সব কটিতে আমাকে সাহায্য করেছিল নটর ডেম কলেজে নিয়মিত সাপ্তাহিক কুইজ দেওয়ার অভিজ্ঞতা। আমার ডাক্তার বন্ধুদেরও একই অভিমত।

এই নীতির সবচেয়ে ভয়ংকর চিন্তা হচ্ছে মাধ্যমিক স্তর থেকে বিজ্ঞান, মানবিক বা ব্যবসায় শিক্ষা উঠিয়ে দেওয়া। ‘গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্স ২০২০ ’-এ ১৩৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ছিল ১১৭ নম্বরে। শিক্ষা র‍্যাঙ্কিংয়ে ১২১ এবং গ্লোবাল ইনোভেশন স্কেলে ১৩২ দেশের মধ্যে ১০৫। যদি মাধ্যমিকেও বিষয়ভিত্তিক শিক্ষা না শেখে, তাদের বেসিক কবে গড়ে উঠবে? দেশের ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও কিন্তু শিক্ষার্থীদের বিষয় বাছাইয়ের সুযোগ আছে।

এখন বলি, এই শিক্ষাব্যবস্থা কেন আমাদের দেশের জন্য প্রযোজ্য নয়। এই দেশে সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থা অনেক ক্ষতি করে গেছে। কারণ, আমাদের শিক্ষকেরা প্রস্তুত ছিলেন না। সঙ্গে গণহারে এ প্লাস পাওয়া নিয়ে বিদেশিদের হাসাহাসি করতে দেখার সাক্ষী আমি নিজে। প্রশ্নফাঁসের কথা নাই-বা বললাম। তদ্রূপ এখনকার এই ব্যবস্থার সঙ্গে আমাদের শিক্ষকেরা একেবারে অপ্রস্তুত। হবেনও না কেন? ক্র্যাফটসের কাজ দেশের কয়জন পারে? স্বল্প সময়ের ট্রেনিংয়ে তাঁদের প্রস্তুত করাও সম্ভব নয়।

এদিকে সমালোচনা না করতে শিক্ষকদের চাপ দিয়ে রাখা হয়েছে। একটা পরীক্ষামূলক সিস্টেমের সমালোচনা না থাকলে তা কীভাবে ভুলত্রুটিমুক্ত হবে? এরপর নতুন পাঠ্যপুস্তক নিয়েও নানা বিতর্ক আমরা দেখলাম। পাঠ্যপুস্তক প্রণেতারা নিজেরাও বোঝেন না কী কী দরকার, আর কোনটা দরকার নয়।

একটা সিস্টেম বদল করতে হলে তার ভেতর থেকে আস্তে আস্তে পরিবর্তন করতে হয়, কিন্তু এই ব্যবস্থা পুরোপুরি বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া, যা নিয়ে ঠিকমতো গবেষণাও হয় নয়। সম্ভবত যাঁরা ছাত্রছাত্রীদের গিনিপিগ বানাচ্ছে, তাঁদের ছেলেমেয়েদের পড়া শেষ হয়ে গেছে অথবা বাইরে থাকে।

২০১৮ সালে বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, গড়ে প্রতিটি শিক্ষার্থীর মোট স্কুল শিক্ষাবর্ষের ৪ দশমিক ৫ বছর নষ্ট হয় নিম্নমানের শিখন-শিক্ষণ বাস্তবতার কারণে। এ কারণে ১১ বছর মেয়াদি স্কুলশিক্ষা শেষে তারা ষষ্ঠ শ্রেণি উপযোগী যোগ্যতা নিয়ে স্কুলজীবন শেষ করছে।

ন্যাশনাল স্টুডেন্টস অ্যাসেসমেন্ট ২০১৭ অনুযায়ী, পঞ্চম শ্রেণির মাত্র ১২ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলায় এবং ১৭ শতাংশ শিক্ষার্থী গণিতে কাঙ্ক্ষিত যোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ইউনেসকোর প্রস্তাবনা ছিল শিক্ষা খাতে জিডিপির ৭ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া, ন্যূনতম হলেও ৫ শতাংশ। কিন্তু আমাদের বাজেটে বরাদ্দ আছে জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এ বরাদ্দই আসলে প্রশ্ন তোলে, সরকার আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ঠিক করতে চায় কি না?

এখানে আরেকটা হতাশাজনক তথ্য হচ্ছে, দেশে এত প্রকাশনা থাকা সত্ত্বেও আমাদের বইগুলা বিদেশ থেকে ছাপিয়ে আনতে গিয়ে একটা বিশালসংখ্যক ডলার বিদেশ চলে যাচ্ছে আর প্রতিবছর সবার টেনশনে থাকতে হয় ঠিক সময়ে বই পাওয়া যাবে কি না। এ রকম তো আগে ছিল না?

এই ব্যবস্থার অবশ্যই ভালো দিক আছে। বাচ্চাদের অনেক ‘সফট স্কিল’, যা আমাদের আগের ব্যবস্থায় ছিল না, তা গড়ে উঠবে। তাদের ওপর কমবে মানসিক চাপ। কিন্তু তারা তাত্ত্বিকভাবে হয়ে যাবে চরম দুর্বল। আমাদের দেশের জন্য যৌথ ব্যবস্থা হতে পারে ভবিষ্যতের পাথেয়। এভাবে চাপিয়ে না দিয়ে সরকারে উচিত সমীক্ষা চালিয়ে ভুলত্রুটি জানা। ইতিমধ্যেই এই নীতি নিয়ে অভিভাবকেরা প্রতিবাদ শুরু করেছেন, হয়েছে মানববন্ধনও। সরকারের উচিত অভিভাবকদের উদ্বেগ বিবেচনায় নেওয়া।

সব দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সেই দেশের সামাজিক অবস্থার সঙ্গে মিলিয়ে করতে হয়। আমাদের দেশ ফিনল্যান্ড নয়। আমাদের ফিনল্যান্ডের পর্যায়ে যেতে ধাপে ধাপে এগোতে হবে। নইলে একবারে খিচুড়ি করে খাইয়ে দিতে গেলে আসলে বদহজম হবে। এই শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের দেশের ইংলিশ মিডিয়ামের সঙ্গেও তুলনীয় হয়নি। তাদের তাত্ত্বিক পড়াশোনা তুলনা করলে সহজেই দেখা যায়, অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজ কারিকুলামে পরীক্ষাপদ্ধতি বাদ দেওয়া হয়নি।

আমাদের পাশের দেশ ভারত, যারা রেমিট্যান্স আনাতে বিশ্বে এক নম্বর, তারা কি ফিনল্যান্ডকে অনুসরণ করছে, নাকি নিজেদের মতো করে গুছিয়ে নিয়েছে? এই শিক্ষানীতি সংশোধন না করলে উপযুক্ত শিক্ষাবিহীন একটা প্রজন্ম গড়ে উঠতে পারে, যার ফলাফল পরমুখাপেক্ষী জাতি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top