সাফ ফুটবল: কিছু আত্মজিজ্ঞাসা

সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতের বিপেক্ষে বাংলাদেশের খেলা দেখে অনেক দর্শক আগ্রহী হয়েছিল। হারিয়ে যাওয়া দর্শক আবার বসেছিল বাংলাদেশ ফুটবল দলের খেলা দেখতে। কিন্তু তাদের হৃদয় ভেঙেছে নেপালের বিপক্ষে জেতা ম্যাচ হেরে যাওয়ায়। ফাইনালে খেলা হয়নি। এবারের আসরে বাংলাদেশের খেলা দেখে নানা রকমের প্রতিক্রিয়া আসছে দর্শকদের মধ্য থেকে। তেমন একটি প্রতিক্রিয়া পাঠকের এই লেখায়।

অনেক দিন পর বাংলাদেশের মানুষ দেশের ফুটবল নিয়ে সজাগ হয়ে উঠেছিল। আমি সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের কথাই বলছি। ফুটবলবিমুখ জাতি যত কিছুই থাকুক বাংলাদেশের খেলার সময় এই কয়দিন টিভি বা ইউটিউবের সামনে ছিল। সবাই বুক বেধেছিল। চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলেও যাতে ফাইনালে খেলতে পারি সেই আশা করেছিল। বলতে গেলে ফাইনাল থেকে ১০ মিনিট দূরে থাকতে আমরা বাদ পড়ি। তা-ও ভুল সিদ্ধান্তে। কিন্তু বাস্তবতা কি ছিল? আমরা কি ফাইনালে যাওয়ার মতো দল ছিলাম?

প্রথম খেলা ছিল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। ওরাই কেবল র‌্যাঙ্কিঙে আমাদের থেকে পিছিয়ে থাকা দল। তাদের বিপক্ষে ১-০ গোলে জিতলেও ১০ জনের দলের সাথে আমরা কি প্রত্যাশা আনুযায়ী খেলতে পেরেছিলাম? পরের ম্যাচ ভারতের সঙ্গে। এটা আমাদের সেরা খেলা ছিল। আমাদের ফুটবল, ক্রিকেট যে খেলাই থাকুক ভারতকে পেলে আমাদের খেলোয়াড়রা জেগে উঠে। ওই ম্যাচে আমরা বেশি ভালো খেলেছি শেষ ৪৫ মিনিট। জিততে না পারলেও আফসোস থেকে যায় ম্যাচটা নিয়ে। মালদ্বীপ আমাদের পুরাই উড়িয়ে দিয়েছে। গোলগড় ভুমিকা না রাখলেও কেন অযথা ফাউল করে পেনাল্টি খেতে হলো? হয়তো ভার থাকলে পেনাল্টি হতো না কিন্তু তাও কেন অযথা ট্যাকল? নেপালের সাথে আমরা প্রথম হাফেই জিতে জেতাম। কিন্তু পরে যা হয়েছে তাতে নেপালের ফিনিশিং ভালো না থাকায় আমরা বরং না হেরে এসেছি।

এই দৃশ্যটা দেখা যায়নি খুব বেশি

এটা তো গেলো দুই তিন লাইনের ম্যাচ সামারি। সাফে ভালো কি কি পেয়েছি? প্রথমত, আমাদের খেলোয়াড়রা তাদের সেরাটা দেয়ার চেষ্টা করেছে। এরকম উজাড় করা খেলা শেষ দেখেছিলাম সল্টলেকে, ভারতের বিপক্ষে। এবার সব ম্যাচেই আমাদের দল চেষ্টা করেছে। কোচ অস্কার ব্রুজোনের কথা না বললেই নয়। তার ম্যাচ রিড, প্লেয়ার বদলানো, ম্যাচ পরিকল্পনা দারুণ ছিলো। বেশ আগের কোচ সামির সাকির আর কোটানের পর একজন কোচ পেয়েছি যিনি প্লেয়ারদের সীমাবদ্ধতা জানেন, জানেন কি করতে যাচ্ছেন। বিপক্ষ দল নিয়ে তার আইডিয়া ক্লিয়ার।

এবার আসি নিজেদের সীমাবদ্ধতা প্রসঙ্গে। প্রথম ম্যাচ থেকেই আমাদের  খেলা দেখে মনে হয়েছে আমরা ‘৯০’ এর ক্যামেরুন। বল মিস করলে অকারণে জার্সি টেনে ধরা, অফ দ্য বল ট্যাকল করা- এই জিনিস বাংলাদেশ দলে আমি অন্তত কখনো দেখিনি। আল্ট্রা ডিফেন্সিভ সামির সাকিরও কখনো এই স্ট্র্যাটেজিতে খেলাননি। কোন শুভ বুদ্ধির কোচের মধ্যেও এভাবে খেলানোর ইচ্ছে থাকবে না। এটা পুরাই আমাদের প্লেয়ারদের দোষ। বলা হচ্ছে এমন খেলার কারণ বাংলাদেশের লিগের রেফারিং, বড় দল বিশেষ করে বসুন্ধরা, আবাহনী, শেখ জামাল, শেখ রাসেলের প্লেয়াররা রেফারির আনুকুল্য পায়।

খেলোয়াড়দের ফুটবলের বেসিক নিয়েও বলতে হচ্ছে। আর একটা পয়েন্ট বাদ যাচ্ছে- কাদা মাঠে খেলা। যেখানে স্কিল লাগে না, লাগে শক্তি। স্যাটেলাইট চ্যানেল টি-স্পোর্টসের কারণে এবার ঘরোয়া লিগও দেখার সুযোগ হয়েছে।  বাফুফে কোচ সালাউদ্দিন সাহেব শুরুতেই বলেছিলেন লিগ সরিয়ে নিয়ে যাবেন শুকনা সিজনে। অন্য সব স্টান্টবাজির মতো এগুলাও কথার কথা হিসেবেই রয়ে গেছে। এই সব ফালতু ফাউলের জন্য খেলার শেষদিকে রেফারির সিদ্ধান্ত আমাদের বিরুদ্ধেই চলে গেছে। ৫০-৫০ না ৪০-৬০ সিচুয়েশনেও আমাদের বিপক্ষে বাঁশি বেজেছে। কারণ আগের ৭০ মিনিটের অকাজ। ভাগ্য ভালো কোন বাজে ইনজুরি হয়নি।

বাস্তবতা হলো চার ম্যাচের মধ্যে আমরা দুই ম্যাচের দুই হাফে ভালো খেলেছি। গোল দিয়েছি মাত্র ৩টা। ৩ গোল দিয়ে কারো ফাইনালে কি হিসাবের মারপ্যাচে ফাইনালে ওঠা উচিত? ফাঁকা পোষ্টে গোল দিতে পারে না এমন স্ট্রাইকার নিয়ে জাতীয় দল কি করবে?

খেলোয়াড়রা মাঠে নেমেছিলো যুদ্ধ করতে- মারামারিতে এগিয়ে থাকলেও ফুটবল খেলাতে তারা কয়টা পাস ঠিক মত দিতে পেরেছে। সংবাদ মাধ্যমে সাফাই গাওয়া হয়েছে টেকটিক্যাল ফাউল বলে। ৪টা খেলাতে যত ফাউল হয়েছে তার ১৫% এর বেশি ট্যাকটিক্যাল ফাউল ছিলো না। আর আমাদের ম্যানেজারও জানে না কাকে ট্যাকটিক্যাল ফাউল বলা যায়। বেশির ভাগ প্রতিপক্ষের আক্রমণে দিশাহীন লং পাস খেলেছে। তা করলে  সামনে তো কাউন্টারে যাওয়ার মতো স্ট্রাইকার থাকতে হবে। শেষ ম্যাচে নেপাল যখন অল আউট অ্যাটাকে গেল তখন ডিফেন্ডার কমিয়ে সেই সুযোগ নেয়ার মতো আমাদের কোন প্লেয়ার সাইড বেঞ্চে ছিলো না।

নেপাল ম্যাচের পর রেফারিকে পুলিশি প্রহরায় মাঠ ছাড়তে হয়েছিল

আমাদের বেশির ভাগ প্লেয়ারের ফুটবল সেন্স আর বেসিকের যে বড় অভাব তার প্রমাণ কিন্তু বিশ্বকাপ বা ইউরোর সময়ে তাদের ম্যাচ অ্যানালাইসিস দেখলেই বোঝা যায়। মেনে নিলাম শিক্ষা তারা শিশু অবস্থায় পাননি- সাফের কয়টা দেশের প্লেয়াররা তা পেয়েছে বলতে পারেন? নিজেদের উন্নত করার জন্য পড়তে হয়, খেলা দেখতে হয়, অন্য দেশ কি করছে জানতে হয়, নিজেদের ফিটনেস নিয়ে কাজ করতে হয়। এখানেই জামাল ভুঁইয়া ব্যতিক্রম। ৩২ বছর বয়সে এখনো দলের যে কোন প্লেয়ারের থেকে ফিট, পাস দিলে অন্তত জানে কেন দিচ্ছে। যেখানে ভারতে খেলোয়াড়রা ইউরোতে ম্যাচ এনালাইসিস করে স্টার স্পোর্টসে সেখানে আমাদের প্লেয়াররা কোন নিউজ পোর্টালেও জায়গা পান না।

সব মিলিয়ে সাফের চার নম্বর হওয়াটাই আমাদের প্রাপ্য। এটাই ন্যায্য। আমি আগে এশিয়া কাপের কোয়ালিফাই এর প্ল্যানিং  নিয়ে লিখেছিলাম যে বাফুফের এখনো কোন প্ল্যান দেখা যাচ্ছে না। সামনে অনূর্ধ-২৩ কোয়ালিফাইং এর খারাপ রেজাল্টের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। ক্লাব ৬০/৭০ লাখ টাকা দিয়ে প্লেয়ার কিনবে , নিজেদের কোন ফ্যাসিলিটি বা জুনিয়র টিম ডেভেলপ করবে না। প্লেয়াররা নিজেদের নিয়ে কোন কাজ করবে না। ভুটান, আফগানিস্থান যদি খেলতো – আমাদের আর ও খারাপ রেজাল্টের জন্য রেডি থাকা লাগতো। এই দেশের ফুটবল মরেনি, তাকে তিলে তিলে খুন করা হচ্ছে। বাঁচানোর কেউ-ই নাই।

প্রশ্ন একটাই – এখন মাঠ আছে, মিডিয়া আছে, দর্শক ও আছে, আছে ক্লাবগুলোর পকেটের টাকাও। ফুটবলের ভালোর জন্য আর কি লাগবে?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top