চারদিকে পদ্মা সেতুর কথা, যাকে বলা হচ্ছে বাংলাদেশের সেরা কাজগুলোর অন্যতম। অবশ্যই বাংলাদেশের মতো একটা দেশের কাছে একসময় এটা ছিল অকল্পনীয়। ঠিক সেই সময়েই বন্যার জন্য আর একটি মিঠামইনের হাওরের মধ্যে দিয়ে যাওয়া রাস্তা চরমভাবে সমালোচিত হয়েছে। আর এ দুটিতেই রয়েছে আমাদের দেশের প্রকৌশলীদের অংশগ্রহণ।
নাথান ডব্লিউ ডগহারথি প্রকৌশলবিদ্যার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, এটি বিজ্ঞান না, অঙ্ক না, সমাজবিজ্ঞান বা অন্য কোনো বইও না। কিন্তু প্রকৌশলীরা যে কোনো সমস্যা তাঁদের সব জ্ঞান এক করেই করেন। আর আইজ্যাক আসিমভ তো আরেক কাঠি সরেস। তাঁর মতে, বিজ্ঞান অনেক মজার এবং আনন্দদায়ক, কিন্তু পৃথিবী বদল করে প্রকৌশলীরা, ওই বিজ্ঞানের সাহায্যেই।
বলা হয়ে থাকে, একজন চিকিৎসকের ভুলে একজন মানুষ মারা যেতে পারে, কিন্তু একজন প্রকৌশলীর ভুলে সভ্যতা বিনষ্ট হতে পারে, বিশ্বাস হয় না? আমাদের কাছের হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো কিন্তু জলজ্যান্ত উদাহরণ।
আজ থেকে প্রায় ১০৮ বছর আগে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের মতো সেতু হয়েছে। এটা সব থেকে সফল উদাহরণ নদী শাসনের। পাশের লালন শাহ সেতু হওয়ার আগে এই সেতুর কাছে কোনো চর পড়েনি। কিন্তু এরপর আর ঠেকানো যায়নি। আধুনিক যমুনা সেতুরও সেই একই অবস্থা। ২০ বছরের মধ্যেই চর পড়ে গেছে। এত টাকায় বানানো যমুনা সেতুতে ফাটল ধরে গেছে। অনেকে বলবেন, এটা তো আমাদের দেশের মানুষেরা করেনি। মানুষ যখন পাথর ঘষে আগুন জ্বালাল, সেই ঘষা থেকেই শুরু আসলে প্রকৌশলবিদ্যার। সত্যিই, আর এখানেই আমাদের দেশের প্রকৌশলবিদ্যা পরাজিত। ১০০ বছরেও ঠিক হিসাব বুঝে নেওয়ার মতো, নিজের দেশের স্বার্থ দেখার মতো প্রকৌশলীর বড় অভাব। আর এই অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে দেশের সব উন্নয়ন প্রকল্পেই।
প্রথমেই আসি এই দেশের ঐতিহ্য সংরক্ষণে ব্যর্থতার কথাতে। তৎকালীন মিসরের গভর্নর মুহাম্মদ আলী পাশা হুট করে পাগলামি সিদ্ধান্ত নিলেন, পিরামিড ভেঙে ওই পাথর দিয়ে নীল নদের বাঁধ বানাবেন। সেই সময়কার প্রধান প্রকৌশলী যিনি ছিলেন, তিনি এর বিপক্ষে। তাই একটা অ্যানালাইসিস করে দেখিয়ে পাশাকে বুঝিয়ে দেন, এর চেয়ে বাইরে থেকে পাথর নিয়ে এসে করলে খরচ কম হবে। এই জিনিস যদি আমাদের দেশে হতো? খামারবাড়ির ব্রিটিশ আমলের বাড়ি ভেঙে ফেলা হলো, ঢাকা ইউনিভার্সিটির মধ্যে দিয়ে মেট্রোরেল গেল, শিলাইদহে করা হলো অদ্ভুত সাদা রং (এখন ঠিক করা হয়েছে), লালনের মাজারের পুরা সবুজকেই তো মেরে ফেলা হলো আধুনিকতার নামে।
বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের আবহাওয়ার জন্য বেশির ভাগ পুরোনো স্থাপনাই টেকে না, কিন্তু যেগুলো টেকে সেগুলোও আমরা নিজেরাই রক্ষা করতে পারি না। অনেকে বলবেন, কর্তার ইচ্ছায় কর্ম! কিন্তু আপনারা কি বিকল্প দেখাতে পারতেন না? যা ধ্বংস হলো বা ভবিষ্যতে হবে, তা কি আর ফিরে পাওয়া যাবে?
এখন বলি পরিবেশ নিয়ে। ঢাকা এখন বায়ুদূষণে এক নম্বর। জ্যামের নগরী এই ঢাকা, কারণ আমাদের প্ল্যানিংয়ের অভাব। এত বড় বড় উন্নয়নকাজ চলছে, তার আগেই তো পরিবেশ সমীক্ষা করে প্রস্তুতি নিয়ে রাখা উচিত ছিল। এখন ধূলা আর কাদায় ছেয়ে যাচ্ছে সব। ঢাকাকে ঠিক করার ব্যাকআপ প্ল্যানগুলোও হচ্ছে বাস্তবতাবর্জিত। তিন পাশে নদী নিয়ে ঢাকাই সম্ভবত একমাত্র বাস অযোগ্য শহর। পরিবেশের ওপর অপরিকল্পিতভাবে হাত দিলে পরিবেশ তার শোধ নেয়; তার বড় প্রমাণ সিলেটের বন্যা। আবার উঁচু উঁচু কাচের বিল্ডিং ঢাকা শহরের তাপমাত্রাও বাড়িয়ে তুলছে। দেশে একটা নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর আছে, আছে আরবান প্ল্যানিং নামের একটা সাবজেক্টও। তাদের কি কোনো কাজে রাখা হয়? কাপ্তাই বাঁধের অনেক সুবিধা আমরা পাই, কিন্তু তার ফলে পরিবেশ নষ্ট হওয়া ছাড়াও ৩ দশমিক ৫ লাখ মানুষ হয়েছিল বাস্তুচ্যুত। হাওরের কথা আগেই বলেছি। মাটি ভরাট করে পানি নামার কোনো জায়গাই রাখা হচ্ছে না। নেই কোনো প্রকল্পের বাস্তব পরিবেশ সমীক্ষা। কিন্তু দেশে পরিবেশ অধিদপ্তর আছে। আর আছে এনভায়রনমেন্ট সায়েন্স আর ইঞ্জিনিয়ারিং নামের দুটি বিষয়, যাতে স্নাতক করা অনেক মানুষও।
এবার আসি ভুল কিংবা পরিকল্পনাহীনতার ক্ষেত্রে। পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকার চারপাশে যে সেতুগুলো হয়েছে, তার নিচ দিয়ে লঞ্চ যেতে পারে না। ফলে নদীপথে চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। প্রতিবেদন অনুসারে, এই সেতুগুলো আবার ভাঙতে হবে। ঢাকার মগবাজার ফ্লাইওভার তো ভুল ডিজাইনের এক উদাহরণ। ভুল ঠিক করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীরও অংশ নিতে হয়েছে। অতিরিক্ত খরচগুলো? প্রায়ই দেখি বিভিন্ন সেতু ভেঙে পড়ছে। বিভিন্ন রাস্তা আর সেতুতে ওজন নেওয়ার ক্ষমতা ৮ থেকে ১০ টন প্রতি এক্সেলে। ফলে ভারী বস্তু নিতে ব্যবহার করতে হচ্ছে নদীপথ, যাতে খরচ ও সময় দুটোই বেশি লাগছে। ১৫ বছর আগেও কলকাতার রাস্তা আমাদের থেকে খারাপ ছিল। এখন ওদের সঙ্গে আমাদের তুলনা করার অবস্থা নেই। ভারতে কিন্তু বেশির ভাগ ট্রান্সপোর্ট সড়কপথেই হয়। তাদের সেতু আর সড়কগুলো সেভাবেই বানানো। কিন্তু আমাদের? আমাদের অন্যতম সফলতা বিদ্যুৎ খাতে। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদনে আমরা সফল হলেও ট্রান্সমিশন লাইনের প্রস্তুতির অভাবে (কাজ চলছে) আমরা সুফল পেতে ব্যর্থ। আর একটা উদাহরণ হচ্ছে পায়রা পোর্ট। এত খরচ করে কবে এই পোর্ট থেকে আমাদের সুফল আসবে, এখনো অজানা!
দেশে কোনো নির্মাণকাজ প্রকৌশলীদের স্বাক্ষর ছাড়া হতে পারে না, সেটি রানা প্লাজা হোক বা পদ্মা সেতু। প্রকৌশলীরা কি তাঁদের এই স্বাক্ষরের মূল্য বোঝেন? আমাদের দেশে গণমানুষের প্রকৌশলী কয়জন।
কারণ কী কী? প্রথম কারণ, সিদ্ধান্ত প্রদানকারীদের মধ্যে টেকনোক্র্যাটের অভাব চরম। বিশেষায়িত মন্ত্রণালয়গুলো নন-টেকনোক্র্যাট দিয়ে চালানো হয়। এরপর আসে ওপর থেকে আসা সিদ্ধান্তের ভুল থাকলে তা জানাতে না পারার সাহসের বিষয়। দুর্নীতি নিয়ে কথা না বলি, এর বিপক্ষে যাওয়ার কারণে গাজীপুর সিটির প্রকৌশলী দেলোয়ার সাহেবের খুন খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। বাধা দিলে ট্রান্সফার পোস্টিংও নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। দুদকের কাছ থেকে মাঝে প্রকৌশলীদের দুর্নীতির কথা শুনলেও আজ পর্যন্ত কোনো তদন্ত দেখা যায় না। মেগা প্রজেক্টের সঙ্গে থাকা মানুষেরা তো মনে হয় ইনডেমনিটি পেয়ে যায়। এরপর আসে ভুল করলে শাস্তির অভাব। কাজে বাধা দেওয়ার জন্য প্রকৌশলীরা নিয়মিত প্রভাবশালীদের হুমকি বা প্রহারের শিকার হলেও সরকারি কাজে ভুলের জন্য বড় কোনো শাস্তি দেখা যায় না। ভুল স্বীকার করতেও দেখা যায় না। ফলে ভুলগুলো রেফারেন্স হয়ে পরের কাজেও থেকে যায়। আর একটা হচ্ছে, যোগ্য লোক ঠিক পজিশনে না থাকা। অযোগ্য, মেরুদণ্ডহীন মানুষ যদি তেলবাজির কারণে ওপরে উঠে যায়, কী হবে তাঁর দ্বারা?
দেশে কোনো নির্মাণকাজ প্রকৌশলীদের স্বাক্ষর ছাড়া হতে পারে না, সেটি রানা প্লাজা হোক বা পদ্মা সেতু। প্রকৌশলীরা কি তাঁদের এই স্বাক্ষরের মূল্য বোঝেন? আমাদের দেশে গণমানুষের প্রকৌশলী কয়জন।
হতাশাবাদীরা বলবেন, বৈশ্বিক শিক্ষার তিনটা সূচকেই আমরা পিছিয়ে। তাদের দিয়ে কী হবে। সত্যি, কিন্তু এবার আসি কী করা যেত? আমাদের প্রকৌশলীরা ক্রিয়েটিভিটিতে পিছিয়ে থাকলেও তা পরিশ্রম দিয়ে পূরণ করে দিতে পারেন। বিশ্বের অনেক বড় কোম্পানিতে তাঁরা সফলভাবে কাজ করে যাচ্ছেন আর যেটার রেশিও যে কোনো অন্য মাধ্যমের থেকে অনেক বেশি। কিন্তু সেই সফল প্রকৌশলীরা দেশে কাজের অভাবে ফিরে আসেন না। তারপর দেশে দেওয়া হয় না এক্সপোজার। নিজেদের থেকে বিদেশিদের ওপর আমাদের অগাধ আস্থা। কিন্তু বিদেশ থেকে আমাদের দেশে তাঁদেরই পাঠানো হয়, যাঁদের বেশির ভাগই ওই দেশের ‘বাতিল মাল’। আবার নন-টেকনোক্র্যাটদের একটা কথা সব জায়গায় চলে, প্রকৌশলীরা ভালো ব্যবস্থাপক নন। এই জন্য রাখা হয় না ডিসিশন মেকিং টিমে। কিন্তু বিশ্বের প্রায় ৭০ শতাংশ বড় কোম্পানির সিইও যে প্রকৌশলী এই জিনিসটা কে বোঝাতে তাদের। দেশে বেসরকারি খাতে এবং বিদেশ যাওয়ার সুযোগ কমে যাওয়াতে, এখন অনেক মেধাবী ছেলে ঢুকছে। তাদের দিয়ে আশা করাই যায়, কিন্তু সুযোগের অভাবে কিংবা সিস্টেমে পরেও তারাও না নিজেদের সীমার মধ্যে আটকে না ফেলে!
২০১০ থেকে আই ট্রিপলই, কোয়েস্ট পেয়ারসহ বিভিন্ন বিজ্ঞানভিত্তিক পেজের একটা কমন টপিক ভবিষ্যৎ পৃথিবী রক্ষা করবে কি প্রকৌশলীরা? কারণ, বিজ্ঞান যে সমাধানই আনুক, তা মাঠে প্রয়োগ করতে হবে প্রকৌশলীদের। বলা হয়ে থাকে, প্রকৌশলীরা নিজেরাই সব এলোমেলো করে নিজেরাই ঠিক করতে বসে। আমাদের দেশ এখন অপরিকল্পিত উন্নয়নে এলোমেলো। বাইরের কনসালট্যান্ট থেকে অনেক শেখারও সুযোগ পেয়েছেন। এখন দেশটাকে কি গুছিয়ে তুলবেন? বিশ্ব যেখানে এগিয়ে যাচ্ছে, আমরা আর কতটা পিছিয়ে থাকব?
বিস্তারিত পড়ুন প্রথম আলোতে