বাংলাদেশে বিদেশি কর্মীর সংখ্যা যেভাবে কমানো সম্ভব

বাংলাদেশের তরুণদের কাছে এখন সবচেয়ে বেশি চাহিদা চাকরির। যেহেতু বেসরকারি খাতের বেশির ভাগ কোম্পানি মোটামুটি খরচ কমানোর চেষ্টা করছে। তাই সরকারি খাত ছাড়া খুব বেশি সুযোগও নেই। সরকারি বিভিন্ন পদে খালি আছে তিন লাখ আটান্ন হাজারের মতো। আইএলওর মতে আমাদের দেশের ১০ শতাংশ তরুণই বেকার, যা ক্রমেই বাড়ছে।

এই বেকারত্ব কমানোর একটা সহজ সমাধান—দেশে যেসব বিদেশি কর্মী কর্মরত আছেন, তাঁদের সঙ্গে কাজ করিয়ে আমাদের এই তরুণদের কর্মদক্ষ করে গড়ে তুলে তাদের স্থানে নিয়ে আসা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে দেশে ২০২০ সালে প্রায় ১১ লাখ বিদেশি অনুমতি সাপেক্ষে কাজ করছেন। কিন্তু বিজনেস ভিসা বা এক বছর করে ই-ভিসা নিয়ে বিডার রেজিস্ট্রেশন ছাড়া কাজ করছেন এই সংখ্যার অনেক বেশি কর্মী। অনেক যে বেশি তা বোঝা যায় ভারতের রেমিট্যান্স প্রদানকারী দেশে চতুর্থ স্থানে বাংলাদেশের থাকা দেখে।

সরকার কি চেষ্টা করছে না? আমাদের ওয়ার্ক পারমিট পাওয়া যথেষ্টই কঠিন। কিন্তু আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের জনগোষ্ঠী প্রস্তুত হতে পারেনি। ফলাফল—তাল মিলিয়ে চলতে গেলে বাইরের শরণাপন্ন হতে হয়। ফলাফল—এভাবে বিদেশিরা কাজ করায় আমাদের টাকা অবৈধ পথে বাইরে চলে যাওয়ার এটাও একটা খাত।
এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায়? এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ আসলে এক দিনে সম্ভব নয়। কিন্তু কাজ শুরু করলে এক বা দুই বছরের মধ্যেই আমাদের বেকারত্ব সমস্যা কমানো অনেকাংশেই সম্ভব।

ওয়ার্ক পারমিটব্যবস্থা সহজীকরণ

আমাদের দেশে অবৈধ বিদেশি কর্মী কাজ করার প্রধান কারণ। এতে সরকার বিপুল রাজস্ব হারায়। আর অনেক টাকা হচ্ছে পাচার। তাই সরকার এই পারমিশন যদি সহজ করে, তাহলে সরকার এসব বিদেশিদের মনিটরিংয়ের মধ্যেও আনতে পারবে।

কিন্তু ওয়ার্ক পারমিট দেওয়ার আগে নতুন শর্ত যুক্ত করতে হবে। নিয়োগকর্তার প্রত্যেক বিদেশি কর্মীর সঙ্গে একজন দেশি কর্মী নিয়োগ করতে হবে, যাতে এক বছর পর তিনি ওই বিদেশি কর্মীর জায়গা নিতে পারবেন। একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর (এক বছর) ওই পদে আর কোনো বিদেশিকে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। আমাদের দেশের নিয়োগকর্তাদের এই মানবসম্পদ তৈরি করাতেই আপত্তি। সরকারের আরও নিশ্চিত করতে হবে, যে পদে বিদেশি আসবেন, সেই পদে দেশে অভিজ্ঞ মানুষ নেই। আর মানহীন বিদেশি কর্মী যেন ঢুকে না যান।

‘সফট স্কিল’ গঠন করা

সফট স্কিলে আমাদের দেশের লোক অনেক অনেক দুর্বল। আমাদের দেশের কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন ট্রেনিং দিয়ে এই ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করছে; কিন্তু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনো এই চেষ্টা খুব বেশি দেখা যায় না। এটা আমাদের কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থার প্রধান দুর্বলতা।

অবৈধ বিদেশিদের ফেরত পাঠানো

সরকার যদি চায়, এটা আসলে খুব বেশি কঠিন নয়। বিজনেস ভিসাতে কত দিন থাকে, আসা-যাওয়ার প্যাটার্ন, রিপোর্ট করা—এসব দেখে ইমিগ্রেশনে খুব সহজেই ধরা যায়। যদি দরকার হয় ইমিগ্রেশন পুলিশকে এ ব্যাপারে ট্রেনিং দিয়ে দক্ষ করা যেতে পারে।

দেশি কোম্পানিগুলোর কাজ করার সুযোগ বৃদ্ধি

একটা বিদেশি টেন্ডারে অংশ নিয়েছিলাম। যা ৫৬টা দেশে পৃথক পৃথকভাবে হয়। সব দেশেই বিদেশি কোম্পানিরা সরাসরি অংশ নিতে পারলেও ভারতে বাধ্যতামূলক ছিল একটা দেশি কোম্পানিকে সঙ্গে রাখা। এভাবেই দেশের কোম্পানিকে সুযোগ দিলে নিজেদের অভিজ্ঞতা এবং সক্ষমতা বাড়ে। উদাহরণস্বরূপ বলি, আজ যদি নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্রে রাশিয়ানদের সঙ্গে আমাদের দেশি কোনো কোম্পানির জয়েন্ট ভেঞ্চার থাকত, ওই কোম্পানির লোকেরা কাজ শিখে নিজেদের তৈরি করতে পারতেন। তাঁরাই পরে আমাদের পরের বিদ্যুৎকেন্দ্র গঠনে সাহায্য করতেন, হয়তো বিদেশেও কোনো নিউক্লিয়ার প্রজেক্টে কাজ করতে পারতেন।

চাকরিজীবীদের পেশাদারত্ব বৃদ্ধি

বিদেশিদের নিয়োগের পেছনে প্রধান কারণ তাদের কাছ থেকে নিয়োগ কর্তারা ‘প্রফেশনাল’ কাজ পান। তাঁরা রিপোর্টে ভালো, যেহেতু বন্ধুবান্ধব কম থাকে, তাঁরা কাজে ফোকাস বেশি দেন, সময় নষ্ট কম করেন। অফিস সময়ের পরেও তাঁরা কাজ করেন। এমনকি ইমোশন কম থাকাতে তাঁরা অনেক নিষ্ঠুর সিদ্ধান্তও নিতে পারেন। আমাদের এই বাস্তবতা মেনে এখন সময়ের চাহিদা মেনে নিজেদের গঠন করতে হবে। আমাদের দেশের মানুষও কিন্তু পারেন। দেশের ৫০টির ওপর বিদেশি কোম্পানির প্রধান নির্বাহী এখন বাংলাদেশি। যেখানে আগে বিদেশি ছিলেন।

শিক্ষাব্যবস্থা উন্নতকরণ

সব শেষে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা উন্নতকরণ। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে চাকরিক্ষেত্রে বাস্তবতার কোনো মিলই নেই। পাস করে এসে প্রায় সবারই নতুন করে শেখা লাগে, ট্রেনিং লাগে। কিন্তু স্নাতক সিলেবাসের মধ্যেই যদি চাকরিক্ষেত্রের চাহিদাগুলো দিয়ে দেওয়া যায়, এখনকার মতো অথই পাথারে পড়া লাগবে না। ইন্ডাস্ট্রিয়াল সংযুক্তকরণ, ইন্টার্নশিপ, থিসিস, কমিউনিকেশন, ম্যানেজমেন্ট আর কম্পিউটার শিক্ষা—সব বিষয়ের সঙ্গে থাকতে হবে। আমাদের সিলেবাসের নিয়মিত আধুনিকীকরণও করা হয় না। অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের সিলেবাস প্রণয়ন কমিটিতে ইন্ডাস্ট্রি এক্সপার্টদের রাখলেও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিষয়গুলো চিন্তাও করা হয় না। যত দিন সিলেবাস ঠিক না করা হবে, আমাদের দেশের নিয়োগকর্তাদের চাহিদা কখনো পূরণ হবে না। অনেক দেশ আমাদের চেনে শ্রমিক পাঠানোর জন্য। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থা যদি আধুনিক করি, আমরা অনেক শিক্ষিত কর্মী পাঠিয়ে বিদেশে আমাদের ইমেজও বদলে দিতে পারব। জনসংখ্যা অনুপাতে রেমিট্যান্স আয়ে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে অনেক অনেক পিছিয়ে শুধু এ কারণে।

সরকারি ট্রেনিং বা ট্যুর নিয়ন্ত্রণে আনা

প্রায় সব প্রজেক্টের মধ্যেই একটি খাত থাকে বিদেশে ট্রেনিং। কিন্তু পরে দেখা যায়, ওই প্রজেক্টেই আবার বিদেশি কর্মী নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। আবার ট্রেনিং করে আসা অনেকেই ওই প্রজেক্টগুলোতে কাজ করার সুযোগ পান না। এদিকে অনেক ভালো কর্মকর্তা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ট্রেনিংয়ে যাওয়ার সুযোগ পান না। এই জায়গাতে নিয়ন্ত্রণ আনার মাধ্যমে নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বিদেশি নিয়োগ কমানো সম্ভব।

নিয়োগকর্তাদের সদিচ্ছা

আমাদের দেশের মালিকদের নিজেদের লোকের থেকে বিদেশিদের ওপর নির্ভরশীলতা বেশি। কিন্তু সুযোগ আর উৎসাহ দিলে আমাদের দেশের কর্মীরাও হয়তো সেই কাজ করতে পারবেন। বাংলাদেশে যে কাজের জন্য বিদেশিদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, আমাদের দেশের লোক অন্য কোনো বিদেশি কোম্পানির অধীনে অন্য দেশে সেই কাজই করছেন। তাঁরা সফলভাবে কাজও করছেন।

আমাকে অনেকেই বলেন, কীভাবে এত বিশাল বেকারত্ব কমানো সম্ভব? আমাদের দেশের মানুষের সমস্যা আমাদের দেশের সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেই সমাধান করতে হবে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, সরকারি চাকরিতে সব পদে নিয়োগ, উদ্যোক্তা বাড়ানো, কৃষি খাত সম্প্রসারণ, শিল্পকারখানা বৃদ্ধি, এসবের সঙ্গে আমরা যদি বিদেশিদের হাতে থাকে চাকরির বাজার নিজ যোগ্যতায় নিয়ে নিতে পারি, তাহলে বেকারত্ব অন্তত এই দেশের কোনো সমস্যা হিসেবে থাকবে না।

বিস্তারিত পড়ুন প্রথম আলোতে

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top