বিসিএস না বেসরকারি চাকরি?

জনসংখ্যার লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির একটা স্তরে এসে বাংলাদেশ একটা সুবিধাজনক স্তরে প্রবেশ করেছিল। সেটা হচ্ছে, আমাদের তরুণ সমাজ এখন সব থেকে বেশি। জনশুমারি ২০২২-এর তথ্য থেকে দেশে ১৯% তরুণ, ২৮% শিশু এবং মোট কর্মক্ষম মানুষ আছে ৬৫.৫১%। এই সংখ্যা আমাদের শক্তি হতে পারত, কিন্তু তা না হয়ে মানুষকে দিন দিন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে তুলছে। এই হতাশা তরুণ থেকে মধ্যবয়সী সবার মধ্যে। সরকার না পারছে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে, না পারছে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে। কিন্তু টেকসই উন্নয়নের মধ্যে ‘জনশক্তি’র উন্নয়ন আছে, কিন্তু আমাদের দেশের উন্নয়ন সংজ্ঞাতে ‘জনশক্তি’ নেই।

তরুণদের হতাশার সব থেকে বড় কারণ দেশে চাকরির বাজার নেই। সরকার ঢাকঢোল পিটিয়ে উদ্যোক্তা বানানোর কথা বললেও, সরকার-ঘনিষ্ঠ লোকজন ছাড়া এই ক্ষেত্রে অন্যদের সুবিধা করা অনেক কঠিন। এর ফলাফল হিসেবে তাদের সবেধন নীলমণি হয়ে যাচ্ছে বিসিএস। কিন্তু সেই প্রক্রিয়া অনেক লম্বা।

যেহেতু চাকরির বাজার খারাপ, দেশের টেকনিক্যাল শিক্ষার মানুষও এখন বিসিএসের চেষ্টা করছেন এবং ভালোও করছেন। এখানে অনেকে তাই আঙুল তুলছেন পিএসসির দিকে। পরীক্ষাপদ্ধতিতে উচ্চতর গণিত ও বিজ্ঞান থেকে বেশি প্রশ্ন আসাতে টেকনিক্যাল লোকজন বেশি সুবিধা পান। পরীক্ষাপদ্ধতি যেহেতু সবার জন্য সমান, পিএসসি অবশ্যই মাধ্যমিক স্তরের মধ্যে হওয়া উচিত।

কিন্তু এখানে আর একটা কথা আছে। যাঁরা বিসিএস পরীক্ষা দিচ্ছেন, তাঁরা অন্ততপক্ষে সাত বছর আগে মাধ্যমিক পাস করে এসেছেন। এই সময়ে সিলেবাস অনেক বদলেছে, তাঁদের তাই নতুন সিলেবাসের জন্যও প্রস্তুত থাকা উচিত। আর প্রশ্নপত্রের আপডেট তো সময়ের দাবি। অ্যানালিটিক্যাল রিজোনিং অবশ্যই সিলেবাসে আসা উচিত, যা মেধা যাচাইয়ে সাহায্য করে।

তাঁদের আর একটা ক্ষোভ, বিসিএসে বিষয়ভিত্তিক সুবিধা না পাওয়া। যেমন লোকপ্রশাসনে পড়া শিক্ষার্থী বিসিএসের অ্যাডমিন ক্যাডারে বা অর্থনীতি পড়া কেউ ইকোনমিক ক্যাডারে সুবিধা পায় না। বাস্তবে আর্টসে পড়া বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই কোনো নির্দিষ্ট সুবিধাবঞ্চিত। এই সমাধানের কোনো উপায় বর্তমান ব্যবস্থায় দেখা যাচ্ছে না। বিষয়ভিত্তিক সুবিধা চালু করতে হলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার।

আর একটা বড় প্রশ্ন, তাঁদের গবেষণার সুযোগ না পাওয়া। আর গবেষণাবঞ্চিত হওয়াতে তাঁদের বিদেশ যাওয়ার সুযোগও কমে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুবই অল্প বাজেট রাখে। সিলেবাসও সেকেলে। বিবিএ, এমবিএ ছাড়া অন্য কোথাও গবেষণাপদ্ধতি পড়ানো হয় কি না, আমার জানা নেই। তাঁদের আবার রিসার্চ না করিয়ে ইন্টার্ন করানো হয়। কিন্তু রিসার্চ মেথডলজি, রিসার্চ, ইন্টার্ন—এসব বিষয়ই স্নাতক সিলেবাসের অংশ হওয়া উচিত।

বাংলাদেশের মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে অনেক কাজের নিজেদের মতো সমাধান করে ফেলে। আর যা দিয়ে অনেক প্রকাশনা সম্ভব। কিন্তু এর জন্য শিক্ষকদের সদিচ্ছা দরকার। যদি গবেষণার মান বাড়ানো যায়, আমাদের অনেক আর্টস-কমার্সের ছাত্রছাত্রীও বিদেশে যাওয়ার সুযোগ পাবেন। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিংও বাড়বে।

এত গেল ছাত্রদের কথা। এখন আসি চাকরিজীবীদের হতাশা নিয়ে। যাঁরা সরকারি চাকরি না পেয়ে বেসরকারিতে যান, তাঁদের বেতন এত কম, যা অনেক ব্যাংকের গার্ডের সঙ্গে তুলনা চলে না। বেতন ঠিকমতো পাওয়া যায় না, অন্যান্য সুবিধা নেই, চাকরি ছেড়ে দিতে গেলে বেতন আটকে রাখে। এর প্রধান কারণ, বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য কোনো প্ল্যাটফর্ম নেই কথা বলার। সরকারের কোনো মন্ত্রণালয় নেই যে দেখভাল করবে। আর মালিকেরা আসলেই তাঁদের চাকরের মানসিকতা নিয়ে দেখেন, যেখানে এইচআর খুবই দুর্বল। কিন্তু বিশ্বে বড় কোম্পানির পদ্ধতি হচ্ছে পিআইপি বা পিপল, ইমেজ আর প্রফিট। আপনার পিপল আপনার বাইরে ইমেজ দেয়। এর থেকে বড় ব্র্যান্ডিং আর কীভাবে সম্ভব?

চাকরি ক্ষেত্রে আর একটা বাধা প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনা। আমাদের মতো ছোট দেশে ৫৩টা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আর ১০৩টা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়( যা ভারতের থেকেও বেশি)। বিশ্বাস হয়? কোনো প্রতিষ্ঠানের মানব সম্পদ বিভাগ কীভাবে এত মানুষের সিভি দেখবে? যদিও সবাই সমান সুযোগ পাওয়ার অধিকার রাখে। আরও বাস্তবতা হচ্ছে, এত এত বিশ্ববিদ্যালয়—কোথাও চাকরির জন্য যে সফট স্কিল লাগে, কেউই শেখায় না। ভালো ভালো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা অনেক ছেলে মেইল করতে পারে না, ইংরেজিতে অনেক দুর্বল, মাইক্রোসফট এক্সেল খুলেও দেখেনি। ফলাফল নিয়োগকর্তারাও শিক্ষার মান নিয়ে হতাশ।

সবাই ধরে নেন, চাকরিতে গিয়ে শিখবে? তাহলে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কী দরকার—অফিসগুলো কোচিং সেন্টার খুলে শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে পারে। এখানে তারাই ভালো করে, যারা এসব সফট স্কিল আগে থেকে শিখে আসে। আর কর্মমুখী শিক্ষার মান নিয়ে কথা বলার কিছু নেই। যদিও অনেক সুযোগ আছে, কিন্তু এর জন্য সিলেবাস আপডেট করতে হবে, শিক্ষকদের মানও বাড়াতে হবে। যারা রাজনৈতিক সুবিধা নিয়ে আশা করে সব হয়ে যাবে, তাদের জেনে রাখা দরকার, ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী (বর্তমানে যমুনা গ্রুপের পরিচালক) বিজনেসস্পট বিডিতে ৩১ জুলাই এক ইন্টারভিউতে বলেছিলেন যে তিনি ১০ দিনে প্রায় ১ হাজার চাকরিপ্রার্থীর সিভি পেয়েছেন, কিন্তু কিছু করতে পারছেন না।

কারণ, চাকরির জন্য উপযুক্ত শিক্ষা তাদের নেই। এরা প্রায় সবাই গ্র্যাজুয়েট ছিল। তাই নিজের কিছু না থাকলে বেসরকারি চাকরিতে টিকে থাকা কঠিন। সিদ্ধান্ত আপনারই, কীভাবে গঠন করবেন নিজেকে?

একটু খেয়াল করে দেখেন তো, দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মধ্যে আমাদের বেকারত্ব সব থেকে বেশি। সেই হিসাবে দেশ কি অরাজক পরিস্থিতিতে আছে? নেই। কারণ, তাঁরা চেষ্টা করছেন, জানতে চাচ্ছেন, তাঁদের অনেকের গঠনমূলক চিন্তা আছে—এটাই সব হতাশার মধ্যে সব থেকে বড় আশার কথা

এই মন্দার সময়ে সবার চাওয়া, দেশে কর্মরত বিদেশি বাদ দিয়ে দেশীদের সুযোগ দেওয়া। কিন্তু এখানেও সেই দক্ষতার ঘাটতি। আর বাংলাদেশের মালিকেরা দেশিদের ওপর দায়িত্ব না দিয়ে বিদেশি দেখলে বেশি সুযোগ দেন। এই মনমানসিকতা পরিবর্তন দরকার। দেশিদের সুযোগ দিলে অন্তত ২ শতাংশ নতুন কর্মসংস্থান বাড়ানো সম্ভব। আর দেশের টাকাটা দেশেই থাকবে।

কর্মঘণ্টা নিয়ে অনেকের অভিযোগ আছে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে সবাই প্রায় দুই দিন ছুটি পেয়ে এসেছে। কিন্তু চাকরিতে তা না থাকায় পরিবারিক জীবনে এর সঙ্গে তাল মেলানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এসব বাস্তবতা পারিবারিক সমস্যারও সৃষ্টি করছে। নিজের অভিজ্ঞতা বলি, কিছুদিন আগে বিভিন্ন কোম্পানির বেশ কয়েকজন সিইও এর সঙ্গে এক আলোচনায় কিছু নতুন তথ্য পেলাম। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য কিছু কোম্পানি শনিবার ছুটি দিয়েছে। এতে অন্যান্য দিন কাজের চাপ বেড়েছে ঠিকই কিন্তু শনিবারের ডিজেল সাশ্রয়ের বিষয়টি হিসাবে নিলে দেখা যাচ্ছে তা অনেক লাভজনক।

মালিকপক্ষ, ভেবে দেখতে পারেন বা সরকারও ছুটি বাধ্যতামূলক করতে পারে। তবে ছুটি শুক্র, শনিবার না করে শনি ও রোববার করলে বিশ্ব পরিস্থিতিতে ভালো হয়।
বর্তমান মুদ্রাস্ফীতির যুগে সবার কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলাফল সঞ্চয় করতে সবার কষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশের আর একটা বড় সামাজিক সমস্যা একজনের আয়ের ওপর বড় ফ্যামিলি নির্ভরশীল।

সামাজিক নিরাপত্তা না থাকাতে আয়ক্ষম ব্যক্তিকেই মা-বাবা, ছোট ভাইবোন সবাইকে দেখতে হয়। এর মধ্যেও কিছুটা হলেও সঞ্চয়ের চেষ্টা করা উচিত। নিজের বেতনের শুরুতেই একটা অংশ জমা দিয়ে, বাকিটাকে মূল বেতন ধরে চালানোর চেষ্টা করা উচিত। ভবিষ্যতের মন্দার জন্য আমাদের সবারই প্রস্তুত থাকতে হবে।

ভালো ডে কেয়ার সুবিধা না থাকাতে অনেক নারী চাকরি বা ব্যবসা করতে পারছেন না। তাঁদের সন্তান রাখার কেউ নেই। আবার মা-বাবা বয়স্ক হলেও দেশে সোশ্যাল সিকিউরিটি না থাকাতে সেই দায়িত্বও অনেক মেয়ের ওপর এসে পড়ে। আর এটা আমাদের নারীর ক্ষমতায়নের একটা বড় অন্তরায়।

এসব তরুণের সব থেকে বড় সমস্যা—তাঁদের কোনো পরিকল্পনা নেই, লক্ষ্য নেই, তাঁরা তাঁদের গন্তব্য জানে না। কিন্তু একটু খেয়াল করে দেখেন তো, দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মধ্যে আমাদের বেকারত্ব সব থেকে বেশি। সেই হিসাবে দেশ কি অরাজক পরিস্থিতিতে আছে? নেই। কারণ, তাঁরা চেষ্টা করছেন, জানতে চাচ্ছেন, তাঁদের অনেকের গঠনমূলক চিন্তা আছে—এটাই সব হতাশার মধ্যে সব থেকে বড় আশার কথা। সরকার তরুণদের শক্তি ব্যবহার করার সুযোগ আর কত হেলায় নষ্ট করবে?

বিস্তারিত পড়ুন প্রথম আলোতে

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top