সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস দেখার কেউ কি আছে?

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সরকার একটু দম ফেলতে পারছে আইএমএফের ঋণের প্রথম কিস্তি চলে এসেছে বলে। এ ছাড়া সরকার আপত্কালীন হিসেবে রিজার্ভে একটা স্থিতিশীলতা এনেছে। যদিও সরকারি হিসাবের সঙ্গে আইএমএফের হিসাবে পার্থক্য আছে। বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের ২০২২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির প্রতিবেদন অনুসারে, আইএমএফের হিসাবে নেট রিজার্ভ আছে ২০ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার, আগামী জুনের মধ্যে ২৪ বিলিয়ন করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে; যদিও সরকারি হিসাবে রিজার্ভ এখনো ৩১ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন।

এদিকে আমাদের ডলারের মান বাজারের সঙ্গে সমন্বয়ের কথা বলা হয়েছে। বেলজিয়ামভিত্তিক রিসার্চ সংস্থা ব্রুগেলের গত ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ করা উপাত্তে দেখা যায়, টাকার সাপেক্ষে ডলারের রিয়েল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট ১৫৫ দশমিক ৪৪, যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক তার সর্বশেষ গত জানুয়ারিতে প্রকাশিত মুদ্রানীতি পলিসিতে দেখিয়েছে ১১০ টাকার মতো। আইএমএফ কোন মানকে সত্য ধরবে?

এদিকে বিশ্বব্যাংকও কর-ভ্যাটের এক উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছে। আপাত আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের সংস্কারের চাপে রয়েছে বাংলাদেশ, কিন্তু বাস্তবে আমাদের অস্বাভাবিক মহাসাগর-এভারেস্ট সব চুরির কারণে সাধারণ মানুষের এখন ত্রাহি দশা। এ সমস্যা থেকে জনগণকে বাঁচানোর জন্য কিছু কাজ জরুরি ভিত্তিতে হাতে নেওয়া উচিত ছিল। সমস্যা সবাই জানি, কারা দায়ী, সেটাও অজানা থাকা উচিত নয়। কিন্তু সমাধান করার আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না।

সব জিনিসের দাম এত বেড়েছে, মানুষের কষ্ট দেখার কেউ নেই। এর মধ্যে হতে পারত খাদ্য সিন্ডিকেট ভেঙে মানুষকে বাঁচার সুযোগ করে দেওয়া। আমাদের দেশের চেয়ে পশ্চিম বাংলার সব জিনিসের দাম কম। এমনকি আমদানি করেও দেখা যায়, তা আমাদের থেকে কম পড়ে অনেক ক্ষেত্রে। কীভাবে সম্ভব! কিন্তু চাষি তাঁর উৎপাদন খরচও পান না। প্রথম আলো ২০২২ সালের ৯ নভেম্বর একটা প্রতিবেদনে দেখিয়েছে, চালের দামে কল মালিকেরা লাভ করেন প্রতি কেজিতে ৮ থেকে ১৪ টাকা।

পাচার করা অর্থ ফেরত আনা

বাংলাদেশের টাকা পাচারের ডেটা পাওয়া যায় ২০২০ পর্যন্ত। এরপর জানা যায়, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের টাকা বেড়েছে। দুবাইয়ে বাংলাদেশিদের ঘরবাড়ি বেড়েছে। খবর পাওয়া যায়, রপ্তানির অনেক টাকা দেশে আসছে না। গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটির ২০০৬-২০২০ পর্যন্ত হিসাবে বলছে, ওই সময় দেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ৮ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা এবং প্রতিবছর পাচার হয় প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা। (সময় নিউজ, ১৪ মে ২০২২) তার মানে এই সময়ে আমরা ১০০ বিলিয়নের বেশি ডলার পাচার করে দিয়েছি। একটু ভেবে দেখুন তো এই টাকা দেশে থাকলে আজ আমাদের অবস্থান কী হতো? দেশের আটটি প্রতিষ্ঠান এই টাকা পাচার ঠেকানোর জন্য কাজ করছে। যার ফলাফল লবডঙ্কা! সরকার তাদের টাকা ফেরত নিয়ে আসার সুযোগ দিয়েছে, কিন্তু কারা টাকা পাচার করেছে, এটা কি সরকার জানে না? তাহলে এতগুলো প্রতিষ্ঠানের মানুষদের অযথা বেতন দেওয়ার কী দরকার? সরকার কি বিদেশে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছে কারা ওই দেশে বিনিয়োগ বা বাড়ি করছে? এই পাচারকারীদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত দেশের সব সাধারণ মানুষদের করতে হচ্ছে।

খেলাপি ঋণ উদ্ধার

প্রথম আলোয় গত ২০ ফেব্রুয়ারি একটা চমকপ্রদ খবর ছিল। দেশে খেলাপি ঋণ কমে হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। খুশি হওয়ার কারণ নেই। আইএমএফের চাপে সরকার টাকা তুলে খেলাপি না কমিয়ে বরং সুযোগ দিয়ে ঋণ কম দেখানোর চেষ্টা নিয়েছে। আমাদের মধ্যে একটা কথা আছে—‘বড়লোকেরা ঋণ নেয় ফেরত না দেওয়ার জন্য’। আসলেই তো যারা ঋণ নেয়, তাদের কত সুবিধা! সরকার সুদ মাফ করে দেয়, সময় বাড়িয়ে দেয়, অল্প কিছু টাকা জমা দিয়ে পুনঃ তফসিলের সুযোগ দেয়, আবার ঋণ নিয়ে আগের ঋণ পুনঃ তফসিলও করা যায়। এ ছাড়া খেলাপি ঋণের লিস্টে নেই সেসব প্রতিষ্ঠানের নাম, তাদের নামে মামলা চলছে। ২০২০ সালের ৩০ জুন প্রথম আলোর তথ্য অনুসারে, আমাদের আদালতে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় থাকা ঋণের পরিমাণ প্রায় ২ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা, যা অবশ্যই খেলাপি ঋণ। টাকা ওঠানোর চেষ্টা কোথায়? আর কত সুযোগ দেবেন? এসব ঋণের বড় অংশ গেছে সরকারি প্রজেক্টে। ফলাফল, দেশে গড়ে ওঠেনি প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিল্পকারখানা। দেশ তাই হতে পারেনি স্বয়ংসম্পূর্ণ, হয়নি নতুন নতুন চাকরির সুযোগ। এদিকে ব্যাংকের তারল্য–সংকট মোকাবিলায় টাকা ছাপানো হচ্ছে, যা মূল্যস্ফীতির অন্যতম কারণ, কিন্তু এর দায় তো আমাদের মতো সাধারণ মানুষের নয়!

অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বন্ধ করা

বিশ্বব্যাংকের ২০১৭ সালের একটা প্রতিবেদন অনুসারে আমাদের নির্মাণ খরচ বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের থেকেই বেশি। এরপরও কমানোর চেষ্টা করা হয়নি। আমাদের বিদ্যুৎ তার প্রয়োজন থেকে বেশি হয়ে যাওয়ার পরও বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ চলছেই। গত ছয় মাসে মাত্র ৩০ শতাংশ ক্যাপাসিটিতেও বিদ্যুৎকেন্দ্র চলার পর ও সরকারকে (পড়ুন আমাদেরকেই) দিতে হচ্ছে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ২১৬ কোটি ডলার গচ্চা (শেয়ার বিজ ৯ মার্চ, ২০২৩)। এর মধ্যে আদানির ‘দামি’ বিদ্যুৎ যোগ হলে আমাদের লস কোথায় যাবে কে জানে! আমাদের এত দামি দামি রাস্তা দু–তিন বছর পর নষ্ট হয়ে যায়, নিতে পারে না প্রয়োজনীয় লোড। কোয়ালিটি দেখার কে আছে? এ ছাড়া এখনো চলছে পায়রা বন্দরের কাজ। কবে শেষ হবে, কেউ জানে না। নদী খনন করে করে কীভাবে একটা বন্দর চালানো যায়? দেশের এ অবস্থায় এসব অপ্রয়োজনীয় খরচ বন্ধ রাখতে পারত না? আমাদের এখনো কেন খরচ বহন করতে হবে? কাদের সুবিধার জন্য?

খাদ্য সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া

সব জিনিসের দাম এত বেড়েছে, মানুষের কষ্ট দেখার কেউ নেই। এর মধ্যে হতে পারত খাদ্য সিন্ডিকেট ভেঙে মানুষকে বাঁচার সুযোগ করে দেওয়া। আমাদের দেশের চেয়ে পশ্চিম বাংলার সব জিনিসের দাম কম। এমনকি আমদানি করেও দেখা যায়, তা আমাদের থেকে কম পড়ে অনেক ক্ষেত্রে। কীভাবে সম্ভব! কিন্তু চাষি তাঁর উৎপাদন খরচও পান না। প্রথম আলো ২০২২ সালের ৯ নভেম্বর একটা প্রতিবেদনে দেখিয়েছে, চালের দামে কল মালিকেরা লাভ করেন প্রতি কেজিতে ৮ থেকে ১৪ টাকা। কিন্তু সেই সময় ১ মণ ধানের উৎপাদন খরচ ৮০০ টাকা, কৃষক পান ৭৬০ টাকা (২২ মে, ডেইলি স্টার) এসব সিন্ডিকেটের নাম মাঝেমধ্যে পত্রিকায় আসেও। খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার ২০২২ সালের ১ জুন একটা অনুষ্ঠানে চালের দামের জন্য ছয়টি করপোরেট কোম্পানির সিন্ডিকেটের কথা বলেছিলেন। এ রকম নাম এসেছে ডিমের, মুরগির, গরুর বা চিনির দাম বাড়ার সময়। কিন্তু একজনকেও কি ধরা হয়েছে? এভাবে অস্বাভাবিক দাম রাখলে আরেক শ্রেণির ব্যবসায়ীরা আমদানি করে ব্যবসা করবেন। এখনই চেষ্টা শুরু করেছেন। তখন আমাদের উৎপাদনকারীদের কী হবে? এর ফলে চলে যাবে মূল্যবান ডলার। পাচার হবে আরও টাকা। কেন আমাদের উৎপাদন খরচ বেশি, সেটা কি খতিয়ে দেখা হয়েছে? কৃষি, স্বরাষ্ট্র, বাণিজ্য, খাদ্য মন্ত্রণালয় তাহলে কী করছে?

অনেক অনেক সমস্যা, অনেক কিছু নিয়ে কথা বলা যায়। আমাদের অবস্থা ‘ভিক্ষা চাই না মা, কুত্তা সামলা’। তাই আপাতত সামলানোর জন্য এই চারটা দিকে নজর দিয়ে সরকার যদি সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিত, অন্তত আমরা কিছুটা হলেও রক্ষা পেতাম। কিন্তু দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কাজ করার কেউ কি এখন আছে?

বিস্তারিত পড়ুন প্রথম আলোতে

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top